বাংলাদেশের ইলিশ রপ্তানি নীতিতে পরিবর্তন এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশী ইলিশের চাহিদা কমে গিয়েছে। অন্যদিকে, দেশীয় ইলিশের উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধির ফলে ভারতীয় ক্রেতারা এখন দেশীয় ইলিশকেই বেশি পছন্দ করছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ রপ্তানির পরিমাণ ক্রমশ কমে আসছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৪,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল, কিন্তু ২০২৪ সালে তা কমিয়ে ৩,০০০ টন করা হয়েছে। এর আগে ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, যদিও পরবর্তীতে দুর্গাপূজার সময় সীমিত পরিমাণে রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হতো।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে সরকার রপ্তানি সীমিত করেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ১.৫ কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম প্রায় ১,৮০০ টাকা (১৫ ডলার) হয়েছে, যা আগের বছর ১,৩০০ টাকা (১০.৯ ডলার) ছিল। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ইলিশ কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাজারে নকল ইলিশের ছড়াছড়ি! খাঁটি ইলিশ চেনার ১০টি অব্যর্থ উপায় জেনে নিন
অন্যদিকে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও অন্যান্য রাজ্যে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে এবং হুগলি নদীতে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। এর ফলে ভারতীয় বাজারে দেশীয় ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে এবং দাম কমেছে।
ভারতের মৎস্য আমদানিকারক সংস্থার সচিব সৈয়দ আনোয়ার মাকসুদ জানিয়েছেন, “আমরা বাংলাদেশ সরকারকে ইলিশ রপ্তানির অনুরোধ করেছিলাম। প্রথমে তারা অস্বীকার করলেও পরে ৩,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাস্তবে মাত্র ২,৪২০ টন রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে মায়ানমার ও ওড়িশা থেকে ইলিশ আসছে এবং কিছু পরিমাণ বাংলাদেশ থেকেও অবৈধ পথে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশী ইলিশের দাম প্রতি কেজি ২,২০০-২,৪০০ টাকার মধ্যে রয়েছে।”
১. দাম বৃদ্ধি: বাংলাদেশে ইলিশের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি করে ভারতে বিক্রি করলে দাম অনেক বেশি পড়ে। ফলে ক্রেতারা স্থানীয় ইলিশ কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন।
২. স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে। বিশেষ করে গঙ্গা, হুগলি ও মহানদীর ইলিশের উৎপাদন ও গুণগত মান উন্নত হয়েছে।
৩. সরবরাহের অনিশ্চয়তা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নীতিগত পরিবর্তনের কারণে ইলিশ রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এতে ভারতীয় আমদানিকারকরা স্থানীয় উৎসের দিকে ঝুঁকছেন।
৪. স্বাদের পার্থক্য: অনেক ভারতীয় ভোক্তা মনে করেন যে স্থানীয় ইলিশের স্বাদ বাংলাদেশী ইলিশের চেয়ে ভালো।
৫. জাতীয়তাবাদী মনোভাব: কিছু ক্রেতা দেশীয় উৎপাদনকে সমর্থন করার জন্য স্থানীয় ইলিশ কিনতে পছন্দ করছেন।
বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, “আমরা দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর আগে ইলিশ রপ্তানি করতে পারি না। এ বছর আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দুর্গাপূজার জন্য ভারতে ইলিশ রপ্তানি সীমিত করতে নির্দেশ দিয়েছি।”
তবে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ৩,০০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “রপ্তানিকারকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী দুর্গাপূজার জন্য নির্দিষ্ট শর্তে ৩,০০০ টন ইলিশ (ভারতে) রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।”
ভারতে বাংলাদেশী ইলিশের চাহিদা কমলেও এখনও পদ্মা নদীর ইলিশের একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। পদ্মার ইলিশ তার উচ্চ ফ্যাট কন্টেন্ট এবং পুষ্ট, সুস্বাদু মাংসের জন্য বিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের বাজারেও পদ্মার ইলিশের চাহিদা রয়েছে।
ভারত-পোল্যান্ড সামাজিক সুরক্ষা চুক্তি: ঘুম উড়ছে শত্রু দেশগুলোর
তবে ভারতীয় ইলিশের গুণগত মান উন্নত হওয়ায় অনেক ক্রেতা এখন স্থানীয় ইলিশ কিনতে পছন্দ করছেন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের ইলিশ এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, এ বছর সুন্দরবনে প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেছে, যার ফলে দাম কিছুটা কমেছে। ৮০ থেকে ১৫০ টাকায় ছোট আকারের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম ইলিশকে কূটনৈতিক উপহার হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ইলিশ উপহার দেন, যা দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জল-বণ্টন চুক্তির পূর্বে ঘটে। ২০১৬ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে ইলিশ পাঠান এবং পরের বছর ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে ইলিশ উপহার দেন।
২০১২ সালে তিস্তা নদীর জল বণ্টন চুক্তি নিয়ে মতভেদের কারণে বাংলাদেশ ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তবে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সুসম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এরপর থেকে শেখ হাসিনার সরকার প্রতি বছর দুর্গাপূজার আগে ইলিশ রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করে আসছিল।
তবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের পর এই ইলিশ কূটনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। প্রথমে নতুন সরকার ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিলেও পরে তা পরিবর্তন করে ৩,০০০ টন রপ্তানির অনুমতি দেয়।
মন্তব্য করুন