পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়ায় ঘটে যাওয়া একটি বর্বর ঘটনা সম্প্রতি সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি স্থানীয় সালিশি সভার নির্দেশে এক দম্পতিকে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হচ্ছে। এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ঘটনার বিবরণ:
২০২৪ সালের ২৮ জুন, চোপড়ার লক্ষীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় একটি সালিশি সভা বসে। সভায় উপস্থিত প্রায় ২০০ জন মানুষের সামনে, তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা তাজিমুল ইসলাম ওরফে ‘জেসিবি’ একটি দম্পতিকে বেত্রাঘাত করেন। অভিযোগ ছিল, দম্পতি একটি অবৈধ সম্পর্কের মধ্যে জড়িত ছিলেন, যা গ্রামের পরিবেশকে দূষিত করছিল।
ভিডিওতে দেখা যায়, তাজিমুল ইসলাম একটি বাঁশের লাঠি দিয়ে দম্পতিকে মারধর করছেন। দম্পতি মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন এবং করুণভাবে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া:
এই ঘটনার পর, বিরোধী দল বিজেপি এবং সিপিআই(এম) তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা শুরু করে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এই ঘটনাকে ‘তালিবানি শাসন’ বলে অভিহিত করেন এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেন। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিমও তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকে ‘বুলডোজার বিচার’ বলে আখ্যা দেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় বিধায়ক হামিদুল রহমান এই ঘটনার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন এবং এটিকে একটি গ্রামীণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন। তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি কানিয়ালাল আগরওয়াল বলেন, দম্পতির অবৈধ সম্পর্ক গ্রামের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল, যা এই ঘটনার কারণ
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর, ইসলামপুর পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করে এবং তাজিমুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। তাকে পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা এই ঘটনার তদন্ত করছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গভর্নরের প্রতিক্রিয়া:
পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর সিভি আনন্দ বোস এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে একটি রিপোর্ট চেয়েছেন। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু ভুক্তভোগীরা তার সাথে দেখা করতে অস্বীকার করায় তিনি তার সফর বাতিল করেন। গভর্নর বোস বলেন, “এই ঘটনা অত্যন্ত বর্বর এবং আমি এই ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব”।
ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া:
ঘটনার পর, ভুক্তভোগী নারী সাংবাদিকদের জানান, তিনি জানেন না কে তাকে মারধর করছিল। তিনি ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। অন্যদিকে, ভুক্তভোগী পুরুষ বলেন, “যা হয়েছে, তা ভালো হয়েছে। আমরা এখন শান্তিতে আছি। আমি আর কোনো ঝামেলা চাই না”।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া:
এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এই ধরনের সালিশি সভার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে যে রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে এবং সাধারণ মানুষ বিচার পাওয়ার জন্য নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে।
চোপড়ার এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির একটি দুঃখজনক প্রতিচ্ছবি। এই ধরনের বর্বর ঘটনা প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। একই সাথে, সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
কি কারণে চোপড়ার এই ঘটনা ঘটে?
চোপড়ার এই ঘটনার পিছনে মূল কারণ হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি উঠে এসেছে:
- অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ: স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত দম্পতি একটি অবৈধ সম্পর্কের মধ্যে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।
- সামাজিক অসন্তোষ: এই অবৈধ সম্পর্ক গ্রামের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল, যা এই ঘটনার একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
- স্থানীয় সালিশি সভার সিদ্ধান্ত: একটি স্থানীয় সালিশি সভা বসে এবং তাদের নির্দেশেই এই দম্পতিকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়।
- রাজনৈতিক প্রভাব: অভিযুক্ত তাজিমুল ইসলাম ওরফে ‘জেসিবি’ একজন স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতা, যার রাজনৈতিক প্রভাব এই ঘটনার পিছনে কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
- আইনের শাসনের অভাব: এই ধরনের ঘটনা ঘটার পিছনে রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
- সামাজিক মূল্যবোধের সংঘাত: গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধের সাথে আধুনিক জীবনযাত্রার সংঘাত এই ধরনের ঘটনার পিছনে কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই কারণগুলি একত্রিত হয়ে চোপড়ার এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটেছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। তবে, এই ধরনের বর্বর ঘটনা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
চোপড়ার ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছে:
- পুলিশি ব্যবস্থা:
- ইসলামপুর পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে।
- মূল অভিযুক্ত তাজিমুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
- তাজিমুল ইসলামকে পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।
- অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা:
- তাজিমুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে আক্রমণ এবং গুরুতর আঘাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
- তদন্ত:
- পুলিশ জানিয়েছে যে তারা এই ঘটনার তদন্ত করছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- রাজনৈতিক পদক্ষেপ:
- তৃণমূল কংগ্রেস তার চোপড়ার বিধায়ক হামিদুল রহমানকে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়েছে।
- গভর্নরের প্রতিক্রিয়া:
- পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর সি.ভি. আনন্দ বোস মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে একটি রিপোর্ট চেয়েছেন।
- ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা:
- ভুক্তভোগী দম্পতি যাতে আর কোনো হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য প্রশাসন তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে।
- সামাজিক সচেতনতা:
- এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেজন্য সরকার সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলি দেখায় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘটনাটিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে, এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
চোপড়ার ঘটনার পর মানববিহারী আন্দোলন কী করেছে
চোপড়ার ঘটনার পর মানবাধিকার সংগঠনগুলি, বিশেষত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC) নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছে:
- NHRC-এর নোটিশ:
- NHRC পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব এবং পুলিশ মহাপরিচালকের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছে।
- এক সপ্তাহের মধ্যে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছে, যাতে পুলিশ তদন্তের অবস্থা, ভুক্তভোগীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং তাদের প্রদত্ত চিকিৎসা সম্পর্কে তথ্য থাকবে।
- তদন্ত দল প্রেরণ:
- NHRC তার ডিরেক্টর জেনারেল (তদন্ত)-কে একটি দল গঠন করে ঘটনাস্থলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে।
- এই দলের নেতৃত্বে থাকবেন কমপক্ষে সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ পদমর্যাদার একজন অফিসার।
- দলটি ঘটনাস্থলে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে এবং কমিশনকে রিপোর্ট দেবে।
- রাজ্য সরকারের কাছে জবাবদিহিতা:
- NHRC রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে যে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বা নেওয়া হবে।
- গভীর উদ্বেগ প্রকাশ:
- NHRC এই ঘটনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গুরুতর বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
- কমিশন মনে করছে যে রাজ্য কর্তৃপক্ষ অতীতের অনুরূপ ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি।
- বৃহত্তর প্রেক্ষাপট বিবেচনা:
- NHRC উল্লেখ করেছে যে এটি পশ্চিমবঙ্গে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
- কমিশন কুচবিহার এবং সন্দেশখালির মতো অন্যান্য স্থানে ঘটে যাওয়া অনুরূপ ঘটনাগুলিরও উল্লেখ করেছে।
- স্পট ইনকোয়ারি:
- NHRC একটি দল পাঠিয়ে ঘটনাস্থলে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলি দেখায় যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চোপড়ার ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং রাজ্য সরকারের কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাইছে। কমিশন শুধু এই নির্দিষ্ট ঘটনা নয়, বরং রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।