ট্রফি ও মেডেল ফেরত দিতে, নির্লজ্জ পাকিস্তানকে কড়া বার্তা বিসিসিআই সচিবের

 এশিয়া কাপ ২০২৫ এর ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ঐতিহাসিক জয়ের পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে যে বেনজির নাটকের সাক্ষী থাকল ক্রিকেট বিশ্ব, তার রেশ ক্রমশ বাড়ছে। ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (BCCI)…

Ani Roy

 

 এশিয়া কাপ ২০২৫ এর ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ঐতিহাসিক জয়ের পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে যে বেনজির নাটকের সাক্ষী থাকল ক্রিকেট বিশ্ব, তার রেশ ক্রমশ বাড়ছে। ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (BCCI) সচিব দেভাজিৎ সাইকিয়া তীব্র ভাষায় এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (ACC) সভাপতি তথা পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (PCB) প্রধান মহসিন নকভির আচরণের নিন্দা করেছেন।1 তাঁর স্পষ্ট দাবি, বিজয়ী ভারতীয় দলের ট্রফি এবং মেডেল যেন অবিলম্বে ফেরত দেওয়া হয়।

দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে রবিবার রাতে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ভারত পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে পরাজিত করে নবমবারের জন্য এশিয়া কাপের খেতাব জেতে। কিন্তু জয় ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের বিতর্ক। এসিসি প্রধান মহসিন নকভি, যিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রীও বটে, তাঁর হাত থেকে পুরস্কার নিতে অস্বীকার করে ভারতীয় দল।2 এরপরেই নকভি ট্রফি এবং মেডেলসহ মঞ্চ ত্যাগ করেন বলে অভিযোগ ওঠে, যা ক্রিকেট ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

এই ঘটনার পরেই ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সোমবার বিসিসিআই সচিব দেভাজিৎ সাইকিয়া সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্ষোভ উগরে দেন। তিনি বলেন, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এসিসি চেয়ারম্যানের হাত থেকে আমরা এশিয়া কাপ ২০২৫-এর ট্রফি গ্রহণ করব না, কারণ তিনি পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওই ভদ্রলোক ট্রফি এবং মেডেলগুলো নিয়ে নিজের হোটেলের ঘরে চলে যাবেন। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ।”

সাইকিয়া আরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলে (ICC) তোলা হবে। তাঁর কথায়, “নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুবাইতে আইসিসি-র সম্মেলন রয়েছে। পরবর্তী সম্মেলনে আমরা এসিসি চেয়ারম্যানের এই আচরণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুতর এবং তীব্র প্রতিবাদ জানাব।”

ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে যা ছিল:

  • ভারতের জয়: ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এ দুবাইতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ ফাইনালে ভারত পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে পরাজিত করে।
  • পুরস্কার প্রত্যাখ্যান: ভারতীয় দল এসিসি ও পিসিবি প্রধান মহসিন নকভির (যিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী) হাত থেকে পুরস্কার নিতে অস্বীকার করে।4 রাজনৈতিক উত্তেজনাই এর মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
  • নকভির বিরুদ্ধে অভিযোগ: অভিযোগ, ভারতীয় দল পুরস্কার নিতে অস্বীকার করার পর মহসিন নকভি বিজয়ীর ট্রফি এবং মেডেলগুলি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন।
  • বিসিসিআই-এর কড়া প্রতিক্রিয়া: বিসিসিআই সচিব দেভাজিৎ সাইকিয়া এই ঘটনাকে “অখেলোয়াড়সুলভ” বলে অভিহিত করেছেন এবং অবিলম্বে ট্রফি ফেরতের দাবি জানিয়েছেন।
  • আন্তর্জাতিক মঞ্চে নালিশ: বিসিসিআই এই বিষয়টি নিয়ে আইসিসি-র পরবর্তী বৈঠকে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া: মহসিন নকভি সামাজিক মাধ্যমে ভারতকে “খেলাধুলার মধ্যে যুদ্ধকে টেনে আনার” জন্য অভিযুক্ত করেছেন। পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আলি আঘা ভারতীয় দলের আচরণকে “ক্রিকেটের প্রতি অসম্মান” বলে মন্তব্য করেছেন।

প্রেক্ষাপট ও সর্বশেষ পরিস্থিতি

রাজনৈতিক উত্তাপের আঁচ ক্রিকেট মাঠে

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার ক্রিকেট ম্যাচ বরাবরই উত্তেজনায় ভরপুর থাকে। তবে সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে এবারের এশিয়া কাপে সেই আঁচ আরও তীব্রভাবে পড়েছে। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই ভারতীয় খেলোয়াড়রা পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সাথে করমর্দন করা থেকে বিরত থাকেন। ফাইনালের আগেও প্রথাগত ফটোশুটে অংশ নেয়নি ভারতীয় দল। ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব টুর্নামেন্টের একটি জয় দেশের সেনাবাহিনীকে উৎসর্গ করার পর পিসিবি তার বিরুদ্ধে আইসিসির কাছে অভিযোগও জানিয়েছিল।

এই টানাপোড়েনের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ফাইনালের পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে। ভারতীয় দল স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে তারা পাকিস্তানের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেবে না।

পরিসংখ্যান ও তথ্যে বিতর্কের মুহূর্ত

  1. পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান বিলম্ব: ম্যাচের পর প্রায় ৯০ মিনিট দেরিতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই সময় দুই বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র আলোচনা চলে।
  2. বিকল্প প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান: ভারতীয় দল এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের সহ-সভাপতি খালিদ আল জারুনির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণে সম্মত ছিল। কিন্তু মহসিন নকভি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বলে জানা গেছে।
  3. আনুষ্ঠানিক ঘোষণা: দীর্ঘ অচলাবস্থার পর ঘোষক সাইমন ডুল মঞ্চ থেকে ঘোষণা করেন, “আমাকে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল থেকে জানানো হয়েছে যে ভারতীয় ক্রিকেট দল আজ রাতে তাদের পুরস্কার গ্রহণ করবে না।”

আধিকারিকদের প্রতিক্রিয়া ও উদ্ধৃতি

বিসিসিআই সচিব দেভাজিৎ সাইকিয়ার কড়া বার্তার পাশাপাশি ভারতীয় দলের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবও এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ম্যাচ পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমি ক্রিকেট খেলা বা দেখা শুরু করার পর থেকে এমন ঘটনা দেখিনি, যেখানে একটি চ্যাম্পিয়ন দলকে তাদের কষ্টার্জিত ট্রফি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার মনে হয়, আমরা এটার যোগ্য দাবিদার ছিলাম।”

অন্যদিকে, এই ঘটনা নিয়ে পিসিবি বা এসিসি থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো বিস্তারিত আনুষ্ঠানিক বিবৃতি জারি করা হয়নি। তবে মহসিন নকভি সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’ (পূর্বতন টুইটার)-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অভিনন্দন বার্তার জবাবে একটি পোস্টে লেখেন, “যদি যুদ্ধই আপনাদের গর্বের পরিমাপ হয়, তবে ইতিহাসে পাকিস্তানের কাছে আপনাদের অপমানজনক হারের রেকর্ড রয়েছে। কোনো ক্রিকেট ম্যাচ সেই সত্যিটা পুনরায় লিখতে পারবে না। খেলাধুলার মধ্যে যুদ্ধকে টেনে আনা কেবল হতাশার প্রকাশ এবং খেলার ভাবমূর্তিকে অসম্মান করা।”

পাকিস্তানের অধিনায়ক সালমান আলি আঘাও ভারতীয় দলের আচরণের সমালোচনা করে বলেন, “তারা আমাদের সাথে করমর্দন না করে, মহসিন নকভির হাত থেকে ট্রফি না নিয়ে শুধুমাত্র আমাদেরই অসম্মান করেনি, তারা ক্রিকেট খেলাটাকেই অসম্মান করেছে।”

সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব ও ভবিষ্যৎ

এই ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ভারতীয় সমর্থকরা তাদের দলের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেও, পাকিস্তানি সমর্থকরা এটিকে ভারতীয় দলের ঔদ্ধত্য হিসেবে দেখছেন। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনা দুই দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্কে আরও তিক্ততা বাড়াবে এবং আইসিসি-র জন্য একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে।

পরবর্তীতে যা দেখার:

  • বিসিসিআই-এর দাবি মেনে পিসিবি বা এসিসি ট্রফি এবং মেডেলগুলি ভারতে ফেরত পাঠায় কিনা।
  • নভেম্বরে আইসিসি-র বৈঠকে এই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
  • ভবিষ্যতে  টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে এর কী প্রভাব পড়ে।

এশিয়া কাপ ২০২৫-এর ফাইনাল ক্রিকেটীয় দক্ষতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংঘাতের মঞ্চ হয়ে উঠল। মাঠের জয়-পরাজয়ের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে মাঠের বাইরের এই বিতর্ক। বিজয়ী দলের ট্রফি না পাওয়া এবং তা নিয়ে দুই দেশের বোর্ডের মধ্যেকার এই নজিরবিহীন কাদা ছোড়াছুড়ি নিঃসন্দেহে ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে এক কালো দাগ রেখে গেল। এখন দেখার, ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি এই বিতর্ক সামাল দিতে কী ভূমিকা পালন করে এবং দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ক্রিকেটীয় সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেয়।

About Author
Ani Roy

অনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এডুকেশনে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ এবং আজীবন শেখার প্রতি প্রতিশ্রুতি নিয়ে অনি নতুন শিক্ষামূলক পদ্ধতি ও প্র্যাকটিসগুলি অন্বেষণ করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তার একাডেমিক যাত্রা তাকে শিক্ষার তত্ত্ব এবং ব্যবহারিক শিক্ষণ কৌশলগুলিতে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করেছে। অনি অন্তর্দৃষ্টি এবং দক্ষতা তার চিন্তাশীল লেখাগুলিতে প্রতিফলিত হয়, যা শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত ও তথ্যপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে লেখা। তিনি তার আকর্ষণীয় এবং প্রভাবশালী কাজের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে থাকেন।