দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। গত কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ঝাড়খণ্ড থেকে বাঁধ থেকে জল ছাড়ার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বন্যাকে “মানুষের সৃষ্ট” বলে অভিযোগ করেছেন।
গত ২০ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ভারী বর্ষণের ফলে বাংলার বিভিন্ন নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (DVC) তাদের বাঁধ থেকে প্রচুর পরিমাণে জল ছেড়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। DVC কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা মঙ্গলবার সকালে ২.১ লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে, যা বুধবার সকালে বেড়ে ২.৫ লক্ষ কিউসেকে পৌঁছেছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন যে, DVC তাঁর সরকারকে না জানিয়েই এত বেশি পরিমাণে জল ছেড়েছে। তিনি বলেছেন, “এত বেশি জল আগে কখনও ছাড়া হয়নি। DVC ৩.৫ লক্ষ কিউসেক জল ছেড়েছে। আমি DVC কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনবার কথা বলেছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।”
বর্তমানে হুগলি, হাওড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান ও পূর্ব বর্ধমান জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। বহু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, ১৮০টিরও বেশি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে এবং প্রায় ৮,০০০ মানুষকে সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি বিশেষ উদ্বেগজনক। স্থানীয় সাংসদ দীপক অধিকারী (দেব) প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং জানিয়েছেন, “নদীর জল বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছি। আমরা নিশ্চিত করব যে পানীয় জল ও খাবারের কোনও অভাব না হয়।”
বীরভূম জেলার লাভপুরে কুরে নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। হুগলি জেলায় দ্বারকেশ্বর নদী পাড় ছাপিয়ে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়ি ছেড়েছেন। বন্যার জলে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল ভেসে গেছে।
রাজ্য সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১০ জন বরিষ্ঠ আইএএস অফিসারকে দায়িত্ব দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “নিম্ন দামোদর অববাহিকা এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। দশজন বরিষ্ঠ আইএএস অফিসারকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
মমতার ‘ভুল’-এর মালা: R.G Kar কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর ৭টি বিতর্কিত মন্তব্য
রাজ্য সরকার ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম চালু করেছে এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু করেছে। কমপক্ষে ১৭টি SDRF দল মোতায়েন করা হয়েছে উদ্ধার কাজের জন্য।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “কেন্দ্র সরকার বাঁধগুলোর ড্রেজিং করে না। ড্রেজিং করা হলে DVC আরও বেশি জল ধরে রাখতে পারত। যখন বাঁধ ৭০-৮০% পূর্ণ হয়ে যায় তখন তারা ধীরে ধীরে জল ছাড়ে না কেন? ঝাড়খণ্ডকে বাঁচাতে তারা বাংলায় জল ছেড়ে দেয়। আমরা আর কতটা অবহেলা সহ্য করব?”
বর্তমান পরিস্থিতিতে, দক্ষিণবঙ্গের বাসিন্দারা উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজ্য সরকার উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার করেছে। তবে আগামী দুই-তিন দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে:
– ১৮০টিরও বেশি ত্রাণ শিবির স্থাপন করা হয়েছে
– প্রায় ৮,০০০ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছে
– ১৭টি SDRF দল মোতায়েন করা হয়েছে উদ্ধার কাজের জন্য
– ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে
– ১০ জন বরিষ্ঠ আইএএস অফিসারকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে
– ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু করা হয়েছে
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবতা নাকি অলীক কল্পনা?
তবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নদী ও বাঁধগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রেজিং এবং জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো এবং আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নতি করা জরুরি।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে এবং প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলতে অনুরোধ করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শীঘ্রই পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন।