শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় পরিচালিত নতুন বাংলা সিনেমা ‘বহুরূপী’ গত ৮ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে মুক্তি পেয়েছে। দুর্গাপুজোর সময় মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি দর্শকদের মন জয় করেছে এবং বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছে।
‘বহুরূপী’ একটি পিরিয়ড অ্যাকশন থ্রিলার ছবি যা ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ঘটা বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আবীর চট্টোপাধ্যায়, ঋতাভরী চক্রবর্তী এবং কৌশানী মুখোপাধ্যায়।
ছবির কাহিনী ঘুরে বেড়ায় বিক্রম (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) নামে এক বহুরূপীর চারপাশে, যে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দানব-দৈত্যের সাজে অভিনয় করে মানুষকে আনন্দ দেয় এবং টাকা রোজগার করে। একটি অলৌকিক স্বপ্নের পর তার মানসিক পরিবর্তন ঘটে। অন্যদিকে আবীর চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন এসআই সুমন্ত ঘোষাল চরিত্রে। একটি বড় ব্যাংক ডাকাতির পর বিক্রম ও সুমন্তর মধ্যে শুরু হয় বিড়াল-ইঁদুরের খেলা। এই তাড়া-হুড়োর মাঝে জড়িয়ে পড়েন পরী (ঋতাভরী চক্রবর্তী) ও ঝিমলি (কৌশানী মুখোপাধ্যায়)।
পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমরা ২০১১ সালে ‘মুক্তোধারা’ ছবির পর থেকেই এই ছবির পরিকল্পনা করছিলাম। ‘বহুরূপী’ সেই সময়কালের একটি ঘটনাপ্রবাহের উপর ভিত্তি করে তৈরি। স্ক্রিপ্টের মাধ্যমে আমরা সেই যুগকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।”
ছবির শুটিং হয়েছে ৮৪টি বিভিন্ন লোকেশনে, ৩৪ দিনের মধ্যে। বোলপুরের জঙ্গলে আবীর চট্টোপাধ্যায় নিজেই পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক রাস্তায় বাইক স্টান্ট করেছেন, কোনো বডি ডাবল ব্যবহার না করে। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বীরভূমের বিষয়পুরের বহুরূপী গ্রামে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন তাদের অনন্য ডায়ালেক্ট শেখার জন্য।
‘বহুরূপী’র টিজার ইউটিউবে প্রকাশের পর থেকেই দর্শকদের মধ্যে উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। টিজার প্রকাশের এক দিনের মধ্যেই ইউটিউবে #২ ট্রেন্ডিং-এ উঠে আসে। এছাড়া IMDb এই ছবিকে বছরের সবচেয়ে প্রত্যাশিত বাংলা ছবি হিসেবে নাম দিয়েছে।
ছবির প্রচারে নতুনত্ব এনেছিলেন পরিচালকদ্বয়। নিউমার্কেটে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় কৌশানীর আইটেম ডান্স এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বহুরূপী সেজে টলিউডের তারকাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যাওয়া দর্শকদের নজর কেড়েছিল।
‘বহুরূপী’ মুক্তির আগে থেকেই টিকিট বিক্রিতে এগিয়ে ছিল। চতুর্থী পর্যন্ত এই ছবির ৫,২৭০টি টিকিট বিক্রি হয়েছিল, যা একই সময়ে মুক্তি পাওয়া সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘টেক্কা’র (৫,১০০টি) থেকে বেশি। প্রথম দিন প্রথম শো-তেই প্রায় হাউসফুল দেখা গিয়েছিল।
সমালোচক প্রচেতা গুপ্ত লিখেছেন, “‘বহুরূপী’ একটা অভিজ্ঞতা, সেখানে রং আছে, রং ধুয়ে ফেলাও আছে। বাংলা সিনেমায় এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ ইদানীং বড় একটা আসে না।” তিনি আরও লিখেছেন, “ছ্যাঁচড়াপুর গ্রামের বহুরূপীর দল এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (বিক্রম)–এর অভিনয় উল্লেখযোগ্য। বহুরূপীদের সঙ্গে বিক্রমের প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটি ভয়ঙ্কর সুন্দর। যেন বড় কোনও শিল্পী ক্যানভাসে এঁকেছেন।”
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় নিয়ে প্রচেতা গুপ্ত লিখেছেন, “শিবপ্রসাদবাবু এক নতুন আঙ্গিকের চরিত্রে অভিনয় করলেন। নতুন সাজে, নতুন ম্যানারিজমে। কঠিন চরিত্র। মাত্রা রক্ষা করা ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। কে জানত, ব্ল্যাক কমেডিতেও তিনি এতটা দড়?”
‘বহুরূপী’র গান ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন ইন্দ্রনাথ মারিক এবং সম্পাদনা করেছেন মলয় লাহা।
চঞ্চলের অভিনয়ে মুগ্ধ দর্শক, ‘পদাতিক’-এ জীবন্ত হয়ে উঠলেন মৃণাল সেন
এই ছবি শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটির অন্যান্য সফল ছবি যেমন ‘বউ সিরিজ’, ‘বর সিরিজ’, ‘বাবা সিরিজ’-এর ধারাবাহিকতায় আরেকটি যোগ করল। তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় নির্বাচনের দক্ষতা এই ছবিতেও প্রতিফলিত হয়েছে।
‘বহুরূপী’ শুধু একটি থ্রিলার নয়, এটি সমাজের গভীর সত্যকেও তুলে ধরেছে। ছবিতে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সাদা-কালোর ধারণা উল্টেপাল্টে যায়। প্রান্তিক শিল্পীদের জীবন, তাদের সংস্কৃতি এবং সভ্যতার সাথে তাদের সম্পর্কও তুলে ধরা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে ‘বহুরূপী’ একটি সফল বাংলা ছবি হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। এটি শুধু বিনোদনই নয়, দর্শকদের ভাবতেও বাধ্য করেছে। শিবপ্রসাদ-নন্দিতার এই নতুন প্রয়াস বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মন্তব্য করুন