বাংলা সাহিত্যের আকাশে নবারুণ ভট্টাচার্য একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা শুধু সাহিত্যের জগতেই নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। আজ আমরা এই প্রখ্যাত কবির রচনার মাহাত্ম্য নিয়ে আলোচনা করব।
নবারুণ ভট্টাচার্য ২৩ জুন ১৯৪৮ পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই মুহূর্তে’ ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়, যা পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগায়।
নবারুণের কবিতায় সমাজ ও রাজনীতির প্রতিফলন লক্ষণীয়। ‘লাল পাহাড়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
“লাল পাহাড় থেকে উঠে আসে অসংখ্য মানুষের চিৎকার যারা নীরবে মরে গেছে কখনো কোনো যুদ্ধে”
এখানে তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-বেদনাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর ‘নক্সালবাড়ি’ কবিতাটিও সমাজের অবহেলিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে।
প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অনুরাগ নবারুণের কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘বৃক্ষ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
“গাছের ডালে পাখি বসে আছে তার পাখায় বাতাস লেগে আছে বাতাসে ভেসে আসে ফুলের গন্ধ”
এই পঙক্তিগুলি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরে।
মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম বর্ণনা নবারুণের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ‘মা’ কবিতায় তিনি মা ও সন্তানের সম্পর্কের গভীরতা অত্যন্ত আবেগময়ভাবে তুলে ধরেছেন।
জোড়াতালি (২০১৭)
নবারুণের কবিতার ভাষা সহজ-সরল, কিন্তু তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে গভীর অর্থ। ‘জল’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:
“জল নামে আকাশ থেকে জল ওঠে মাটি থেকে জলের মধ্যে আমি দেখি আমার মুখের প্রতিবিম্ব”
এই সহজ কথার মধ্যে তিনি জীবনের গভীর দর্শনকে তুলে ধরেছেন।
চিত্রকল্প ও প্রতীকের অভিনব প্রয়োগ নবারুণের কবিতাকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। ‘আগুন’ কবিতায় তিনি আগুনকে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
ছন্দের ক্ষেত্রেও নবারুণ নতুনত্ব এনেছেন। তিনি পরম্পরাগত ছন্দের পাশাপাশি মুক্তছন্দও ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর কবিতাকে দিয়েছে একটি আধুনিক মাত্রা।
নবারুণের কবিতা সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের প্রতিবাদ করে। ‘ভিখারি’ কবিতায় তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন।
মানবিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি ‘মানুষ’ কবিতায়:
“মানুষ হওয়া কঠিন কাজ তবু মানুষ হতে হবে”
আধুনিক জীবনের জটিলতা নবারুণের কবিতায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ‘শহর’ কবিতায় তিনি নগর জীবনের নিঃসঙ্গতা ও যান্ত্রিকতার কথা তুলে ধরেছেন।
নবারুণের কবিতা নতুন প্রজন্মের কবিদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর সহজ-সরল ভাষা ও গভীর ভাবনা অনেক তরুণ কবিকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশিষ্ট কবি সুবোধ সরকার বলেছেন, “নবারুণের কবিতা আমাদের চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করেছে।”
বাংলা কবিতার ধারায় নবারুণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর কবিতায় সমাজ-সচেতনতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতির সমন্বয় ঘটেছে, যা বাংলা কবিতাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছে।
বিশিষ্ট সমালোচক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় নবারুণের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, “নবারুণের কবিতায় আমরা দেখতে পাই সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার অপূর্ব মিশ্রণ।”
নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর সাহিত্যিক অবদানের জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১০ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার অনন্য বৈশিষ্ট্য হল তার সহজবোধ্যতা ও গভীরতার সমন্বয়। তিনি জটিল বিষয়কে সহজ ভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন, যা তাঁর কবিতাকে করেছে জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলা সাহিত্যে নবারুণের অবদান অপরিসীম। তিনি শুধু একজন কবি নন, একজন সমাজ সংস্কারকও বটে। তাঁর কবিতা আমাদের চিন্তা করতে শেখায়, প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ, যা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে থাকবে।
মন্তব্য করুন