Ishita Ganguly
২৩ জুন ২০২৪, ৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

শব্দের জাদুকর: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি

Birth Anniversary of Nabarun Bhattacharya

বাংলা সাহিত্যের আকাশে নবারুণ ভট্টাচার্য একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা শুধু সাহিত্যের জগতেই নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। আজ আমরা এই প্রখ্যাত কবির রচনার মাহাত্ম্য নিয়ে আলোচনা করব।

নবারুণ ভট্টাচার্য ২৩ জুন ১৯৪৮ পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই মুহূর্তে’ ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়, যা পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগায়।

কবিতার বিষয়বস্তু:

নবারুণের কবিতায় সমাজ ও রাজনীতির প্রতিফলন লক্ষণীয়। ‘লাল পাহাড়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

“লাল পাহাড় থেকে উঠে আসে অসংখ্য মানুষের চিৎকার যারা নীরবে মরে গেছে কখনো কোনো যুদ্ধে”

এখানে তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-বেদনাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর ‘নক্সালবাড়ি’ কবিতাটিও সমাজের অবহেলিত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে।

প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অনুরাগ নবারুণের কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘বৃক্ষ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

“গাছের ডালে পাখি বসে আছে তার পাখায় বাতাস লেগে আছে বাতাসে ভেসে আসে ফুলের গন্ধ”

এই পঙক্তিগুলি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরে।

মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম বর্ণনা নবারুণের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ‘মা’ কবিতায় তিনি মা ও সন্তানের সম্পর্কের গভীরতা অত্যন্ত আবেগময়ভাবে তুলে ধরেছেন।

গ্রন্থতালিকা

কাব্যগ্রন্থ

  • এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না (১৯৮৩)
  • পুলিশ করে মানুষ শিকার (১৯৮৭)
  • রাতের সার্কাস

ছোটগল্প

  • হালাল ঝাণ্ডা (১৯৮৭)
  • নবারুন ভট্টাচার্যের ছোটগল্প (১৯৯৬)
  • নবারুন ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ গল্প
  • ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক
  • ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক
  • ফ্যাতাড়ু বিংশতি

উপন্যাস

  • হারবার্ট (১৯৯৩)
  • যুদ্ধ পরিস্থিতি (১৯৯৬)
  • অটো ও ভোগী
  • ফ্যাতাড়ু ও চোক্তার
  • কাঙাল মালসাট
  • মবলগে নভেল
  • খেলনা নগর
  • লুব্ধক (২০০৬)

অন্যান্য

জোড়াতালি (২০১৭)

ভাষা ও শৈলীর বৈশিষ্ট্য:

নবারুণের কবিতার ভাষা সহজ-সরল, কিন্তু তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে গভীর অর্থ। ‘জল’ কবিতায় তিনি লিখেছেন:

“জল নামে আকাশ থেকে জল ওঠে মাটি থেকে জলের মধ্যে আমি দেখি আমার মুখের প্রতিবিম্ব”

এই সহজ কথার মধ্যে তিনি জীবনের গভীর দর্শনকে তুলে ধরেছেন।

চিত্রকল্প ও প্রতীকের অভিনব প্রয়োগ নবারুণের কবিতাকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। ‘আগুন’ কবিতায় তিনি আগুনকে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

ছন্দের ক্ষেত্রেও নবারুণ নতুনত্ব এনেছেন। তিনি পরম্পরাগত ছন্দের পাশাপাশি মুক্তছন্দও ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর কবিতাকে দিয়েছে একটি আধুনিক মাত্রা।

সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা:

নবারুণের কবিতা সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের প্রতিবাদ করে। ‘ভিখারি’ কবিতায় তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন।

মানবিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি ‘মানুষ’ কবিতায়:

“মানুষ হওয়া কঠিন কাজ তবু মানুষ হতে হবে”

আধুনিক জীবনের জটিলতা নবারুণের কবিতায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ‘শহর’ কবিতায় তিনি নগর জীবনের নিঃসঙ্গতা ও যান্ত্রিকতার কথা তুলে ধরেছেন।

সাহিত্যিক প্রভাব:

নবারুণের কবিতা নতুন প্রজন্মের কবিদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর সহজ-সরল ভাষা ও গভীর ভাবনা অনেক তরুণ কবিকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশিষ্ট কবি সুবোধ সরকার বলেছেন, “নবারুণের কবিতা আমাদের চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করেছে।”

বাংলা কবিতার ধারায় নবারুণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর কবিতায় সমাজ-সচেতনতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতির সমন্বয় ঘটেছে, যা বাংলা কবিতাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছে।

সমালোচনা ও স্বীকৃতি:

বিশিষ্ট সমালোচক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় নবারুণের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, “নবারুণের কবিতায় আমরা দেখতে পাই সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার অপূর্ব মিশ্রণ।”

নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর সাহিত্যিক অবদানের জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১০ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়।

পুরস্কার

  • সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৯৩)
  • বঙ্কিম পুরস্কার
  • নরসিংহ দাস পুরস্কার

যা না বললেই নয়

নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার অনন্য বৈশিষ্ট্য হল তার সহজবোধ্যতা ও গভীরতার সমন্বয়। তিনি জটিল বিষয়কে সহজ ভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন, যা তাঁর কবিতাকে করেছে জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলা সাহিত্যে নবারুণের অবদান অপরিসীম। তিনি শুধু একজন কবি নন, একজন সমাজ সংস্কারকও বটে। তাঁর কবিতা আমাদের চিন্তা করতে শেখায়, প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করে। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ, যা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে থাকবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঊর্ধ্বগতি: রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় ছাত্রদের

ভারতে ইন্টারনেট বিপ্লবের নতুন দিগন্ত: স্টারলিঙ্কের সঙ্গে এয়ারটেলের ঐতিহাসিক চুক্তি

অস্ত্র আমদানির দৌড়ে শীর্ষে ইউক্রেন, ভারতের স্থান দ্বিতীয়: বিশ্বে কী বার্তা?

মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে নজর! বঙ্গের সব আসনে লড়তে প্রস্তুত আইএমআইএম

হোলির রঙে ব্যাঙ্ক বন্ধ: আগামীকাল থেকে টানা ৪ দিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাঙ্ক ছুটি, তালিকা দেখে নিন

কেকেআরের প্রস্তুতি শুরু: কলকাতায় নাইটদের ক্যাপ্টেন-কোচের সঙ্গে প্রকাশিত হল প্র্যাক্টিস সূচি

শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে ‘ক্রিমিনাল’ পোস্টার: সিপিএম নেতার থানায় তলব!

কলকাতার Zakaria Street-এর মাস্ট ভিজিট ফুড স্টল: একটি খাদ্যপ্রেমীর স্বর্গভূমি

অলক্ষ্যে ঋত্বিক: ঋত্বিক ঘটকের জীবনালেখ্য নিয়ে আসছে বাঙালির প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র

আইপিএল-এ তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধ! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কড়া নির্দেশ জারি!

১০

দেওয়ালের কোন দিকে কোন রঙ শুভ? বাস্তুশাস্ত্রের চোখে একটি গভীর দৃষ্টিপাত

১১

ডিএলএফ-এমআরএফ-আমূল-পেটিএম: সংক্ষিপ্ত নামেই ভারত বিখ্যাত, এবার জেনে নিন এই ব্র্যান্ডগুলোর পুরো নাম!

১২

সেক্সসমনিয়া: ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিরল রহস্য

১৩

ভীষণ ক্ষতিকর Non-Stick প্যানে রান্না করছেন না তো? জেনে নিন সেরা বিকল্পগুলো

১৪

কাক ডাকার ফলাফল: ইসলাম ও হিন্দু শাস্ত্রে কী বলা আছে?

১৫

দিনে ৮ ঘণ্টা AC চালালে মাসে কত ‘Electric Bill’ আসবে? সহজ হিসেবে নিশ্চিন্তে থাকুন

১৬

প্রাক্তনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কি বুদ্ধিমানের কাজ? একটি গভীর বিশ্লেষণ

১৭

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের জাদু: কীভাবে ভারত হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য?

১৮

বাংলার প্রথম এসি লোকাল ট্রেন শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর রুটে, ভাড়া কত জানেন?

১৯

ভারতে রাজ্যভিত্তিক হীরার মজুদ: কোন রাজ্য হীরা উৎপাদনে সেরা?

২০
close