বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের অধীনে ভৌগোলিক নির্দেশক রেজিস্ট্রি পশ্চিমবঙ্গের সাতটি পণ্যকে জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) তকমা প্রদান করেছে। এই পণ্যগুলি হল – নোলেন গুড়ের সন্দেশ, মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া, বিষ্ণুপুরের মোতিচুর লাড্ডু, কামারপুকুরের সাদা বোঁদে, মালদার নিস্তারি রেশম সুতো, রাঁধুনিপাগল চাল এবং বারুইপুরের পেয়ারা। এই নতুন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলার জিআই তকমাপ্রাপ্ত পণ্যের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫, যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক।
জিআই তকমা হল একটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি, যা কোনো পণ্যের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থল এবং সেই অঞ্চলের বিশেষ গুণাবলির প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। বাংলার এই সাতটি পণ্যও তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং উৎপাদন পদ্ধতির স্বতন্ত্রতার জন্য এই মর্যাদা পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিষদের পেটেন্ট ইনফরমেশন সেন্টার এসব পণ্যের উৎপত্তিস্থল এবং উৎপাদন পদ্ধতির ঐতিহাসিক প্রমাণ সংগ্রহ করে জিআই রেজিস্ট্রারের কাছে পেশ করেছিল।
সাম্প্রতিক এই ঘোষণার আগে কামারপুকুরের সাদা বোঁদের জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার প্রত্যাশায় উৎসাহিত ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি ছিল, ভূ-ভারতে কামারপুকুর ছাড়া আর কোথাও সাদা বোঁদে তৈরি হয় না, তাই এই মিষ্টি পাওয়ার যোগ্য স্বীকৃতি পাওয়ারই যোগ্য। স্থানীয় মিষ্টি ব্যবসায়ী বীরেশ্বর মোদক জানিয়েছিলেন, “জিআই স্বীকৃতি পেলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই মিষ্টির রফতানির পথও সুগম হবে”।
মালদার নিস্তারি রেশম সুতো এবং রাঁধুনিপাগল চালের মতো কৃষিপণ্যও এবার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। মালদার নিস্তারি রেশম সুতো বাংলার রেশম শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা বুনন শিল্পের বিকাশে অবদান রেখেছে। অন্যদিকে, রাঁধুনিপাগল চাল একটি স্থানীয় চালের প্রজাতি, যার স্বাদ ও গুণমান অনন্য।
সুন্দরবনের মধু বা ‘মৌবন’ এবং জলপাইগুড়ির কালো নুনিয়া চাল, যাকে ‘চালের রাজপুত্র’ও বলা হয়, সম্প্রতি জিআই তকমা পেয়েছে। সুন্দরবনের ‘মৌলি’ সম্প্রদায় দ্বারা সংগৃহীত এই মধু স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মুর্শিদাবাদের মির্জাপুর অঞ্চল থেকে উৎপন্ন কাদিয়াল শাড়ি, তাঁগাইল এবং গোরদ শাড়িও জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জিআই তকমা এসব পণ্যের বাজারযোগ্যতা বাড়াবে, বিশেষ করে বিদেশি বাজারে, যেখানে এই তকমা প্রামাণিকতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। তবে কড়া মানদণ্ড প্রয়োগের ফলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। ২০১৭ সালে ওড়িশার সঙ্গে দীর্ঘ বিতর্কের পর রসগোল্লার জিআই তকমা পাওয়ার ঘটনা এই প্রক্রিয়াকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছিল।
বাংলার জিআই তকমাপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকায় আরও রয়েছে দার্জিলিং চা, লক্ষ্মণভোগ আম, হিমসাগর আম, জয়নগরের মোয়া, বর্ধমানের সিতাভোগ ও মিহিদানা, গোবিন্দভোগ চাল, বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্প এবং বালুচরি ও ধনিখালি শাড়ি। দার্জিলিং চা ভারতের প্রথম জিআই তকমাপ্রাপ্ত পণ্য হিসেবে স্বীকৃত, যা “চায়ের শ্যাম্পেন” হিসেবে পরিচিত।
নকশি কাঁথা, যা গ্রামীণ বাংলার মহিলা শিল্পীদের হাতে তৈরি, এর বিচিত্র সেলাইয়ের কাজ এবং গল্প বলার শিল্প হিসেবে পরিচিত। শান্তিনিকেতনের চামড়ার পণ্য, শান্তিপুরের শাড়ি, বালুচরি শাড়ি, ধনিখালি শাড়ি, বাঁকুড়া পাঁচমুড়ার টেরাকোটা শিল্প, বাংলা ডোকরা, বাংলা পটচিত্র, পুরুলিয়া ছাউ মুখোশ, কুশমন্ডির কাঠের মুখোশ এবং মাদুরকাঠিও বাংলার জিআই তকমাপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকায় রয়েছে।
মাদুরকাঠি, যা বহুরঙা হস্তশিল্প পণ্য, বাংলার ভেজা ও কাদামাটি এলাকায় জন্মে এবং বাঁশের ফ্রেমে তৈরি করা হয়। বাংলার গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া মোকাবিলা করতে সক্ষম, মাদুরকাঠিতে রয়েছে অপরিবাহী এবং ঘাম শোষণের ক্ষমতা।
জিআই তকমা শুধু পণ্যের মানের গ্যারান্টি নয়, বরং স্থানীয় উৎপাদকদের আর্থিক উন্নতির পথও সুগম করে। কামারপুকুরের সাদা বোঁদে, মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া, বিষ্ণুপুরের মোতিচুর লাড্ডু, নোলেন গুড়ের সন্দেশ, মালদার নিস্তারি রেশম সুতো, রাঁধুনিপাগল চাল এবং বারুইপুরের পেয়ারার জিআই তকমা পাওয়া শুধু স্থানীয় অর্থনীতির জন্য নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
প্রয়াত বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি “যেখানে সীমাবদ্ধতা নেই, সেখানেই জীবনের প্রকাশ পূর্ণতা পায়”, বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাদ্য, শিল্প এবং কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জিআই তকমা এই পণ্যগুলিকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করতে সাহায্য করবে এবং স্থানীয় শিল্পীদের আর্থিক স্বাবলম্বীতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
বাংলার এই সাতটি পণ্য শুধু খাদ্য ও হস্তশিল্পের নমুনা নয়, এগুলি বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মেধার প্রতীক। এই জিআই তকমা প্রাপ্তি শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এই অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।