ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ সমন্বিত সেল ও জিন থেরাপি (সিজিটি) কেন্দ্র স্থাপন করেছে প্রখ্যাত টিকা নির্মাতা সংস্থা ভারত বায়োটেক। বৃহস্পতিবার সংস্থাটি ঘোষণা করেছে যে, তারা দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের জিনোম ভ্যালিতে এই অত্যাধুনিক কেন্দ্র স্থাপনে ৭৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৬৪৮ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করেছে এবং আগামী তিন বছরের মধ্যে তাদের নতুন থেরাপিগুলি বাজারে আনার লক্ষ্য রাখছে।
টিকা উৎপাদনের পাশাপাশি এবার জটিল সেল ও জিন থেরাপির ক্ষেত্রে নিজেদের বিস্তৃত করছে ভারত বায়োটেক। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রিসিডেন্স রিসার্চের তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী এই বাজার ২০২৪ সালের ২১.২৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০৩৪ সালে ১১৭.৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
সংস্থার চিফ ডেভেলপমেন্ট অফিসার রাচেস এলা জানিয়েছেন যে, ৫০,০০০ বর্গফুটের এই বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন কেন্দ্রটি আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যকর হবে1। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, বর্তমানে সংস্থাটি দুটি সেল থেরাপি এবং তিনটি জিন থেরাপির উপর কাজ করছে।
সেল ও জিন থেরাপি হল একটি জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে রোগীর শরীরে পরিবর্তিত স্বাস্থ্যকর কোষ বা জিন প্রবেশ করানো হয় বিভিন্ন অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য6। এই অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি প্রধানত জেনেটিক ব্যাধি, জটিল ক্যান্সার এবং অটোইমিউন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ভারত বায়োটেকের নির্বাহী চেয়ারম্যান ডঃ কৃষ্ণ এলা বলেছেন, “জিন ও সেল থেরাপি বর্তমানে উপলব্ধ সবচেয়ে জটিল, বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত চিকিৎসার মধ্যে অন্যতম, যা নির্ভুল জেনেটিক পরিবর্তন এবং বিশেষায়িত উৎপাদন দক্ষতার মতো জটিল প্রক্রিয়া সম্পর্কিত”। তিনি আরও যোগ করেন, “ভারত বায়োটেক, ভাইরাল ভ্যাকসিন উৎপাদনে তার বিশাল অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণিত উৎকর্ষতার সাথে, এই জটিলতাগুলি আয়ত্ত করতে এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় ও সামঞ্জস্যে মানব-গ্রেড ভেক্টর উৎপাদন করতে অনন্যভাবে সক্ষম”।
মূলত অনকোলজি (ক্যান্সার) এবং দুর্লভ রোগের চিকিৎসায় মনোনিবেশ করবে সংস্থাটি। রাচেস এলা ব্যাখ্যা করেছেন, “সেল থেরাপিগুলি প্রধানত রোগীদের জন্য কাস্টমাইজড চিকিৎসা, যখন জিন থেরাপিগুলি বৃহত্তর জনসংখ্যার জন্য বড় ব্যাচে তৈরি করা যেতে পারে। ভারত বায়োটেক জিন থেরাপিতে বেশি মনোযোগ দিতে চায়”।
সংস্থার নতুন সেল ও জিন থেরাপি কেন্দ্রটি উচ্চ-মাত্রার ভাইরাল ভেক্টর (এএভি, লেন্টিভাইরাস, অ্যাডেনোভাইরাস) উৎপাদন করতে সক্ষম হবে, যা সেল ও জিন থেরাপির জন্য অপরিহার্য। এটি রক্ত ক্যান্সার, কঠিন অঙ্গের ক্যান্সার এবং জেনেটিক ব্যাধিসহ বিভিন্ন রোগের জন্য একাধিক প্ল্যাটফর্ম পণ্য উৎপাদনের ক্ষমতাও রাখে।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, ভারত বায়োটেক উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৃষাণু সাহার সাথে সহযোগিতা করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে পরবর্তী প্রজন্মের কিমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপ্টর (সিএআর) সেল থেরাপি বিকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রফেসর সাহা মন্তব্য করেছেন, “সম্ভাব্য নিরাময়কারী সেল ও জিন থেরাপির জন্য জৈব উৎপাদনে উদ্ভাবনগুলি বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত হয়। ভারতে, বিশেষ করে ভারত বায়োটেকে, নতুন ধারণাগুলি বিকাশ এবং স্কেল করার দক্ষতা ও প্রতিশ্রুতি দেখতে পাওয়া উত্তেজনাপূর্ণ”।
ভারতের তুলনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশে সেল ও জিন থেরাপি অনেক বেশি উন্নত এবং ভারতে এখনও এর ব্যবহার সীমিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে, রাচেস এলা বলেছেন যে, সংস্থাটি মূল্য-সংবেদনশীল ভারতীয় বাজারের জন্য এই থেরাপিগুলিকে সাশ্রয়ী করার চেষ্টা করছে1। “বর্তমানে ভারতে চিকিৎসার দাম প্রায় ৫ মিলিয়ন রুপি (৫৭,৯০০ ডলার)… আমরা এর চেয়ে কম দামে আনার চেষ্টা করছি,” এলা উল্লেখ করেছেন।
এই নতুন সিজিটি সুবিধা ভারত বায়োটেকের পারম্পরিক টিকা থেকে ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসায় সম্প্রসারণের ব্যাপকতর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সারিবদ্। সংস্থার কৌশলগত বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব গঠনে প্রমাণিত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে, এই উদ্যোগ উন্নত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলিকে – শক্তিশালী থেরাপিউটিক ভেক্টর থেকে শুরু করে ইন ভিভো কিমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপ্টর তৈরি পর্যন্ত – বাস্তব জগতের সমাধানে দ্রুত রূপান্তরিত করতে সক্ষম করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উদ্যোগ ভারতের স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। ভারত বায়োটেক দশকের পর দশক ধরে গুরুতর রোগের জন্য সাশ্রয়ী টিকা বিকাশ ও উৎপাদনে ভারতের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছে। এখন তারা বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন এবং ব্যাপক সাশ্রয়ী মূল্যের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে দেশ ও বিশ্বের জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সুলভ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে।
ভারত বায়োটেকের এই নতুন উদ্যোগ ভারতীয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, যা দেশে জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং ভারতকে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নিয়ে যাবে।