হাসির আড়ালে জীবনের গভীর পাঠ: বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী সাহিত্য বিশ্লেষণ

বাংলা সাহিত্যের সুবিশাল প্রাঙ্গণে, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Mukhopadhyay) এক অনন্য স্থান দখল করে আছেন। তিনি সেই বিরল সাহিত্যিকদের একজন, যিনি হাসির নির্মল নির্ঝরের সাথে জীবনের গভীর উপলব্ধি ও মানবিকতার এক…

Ishita Ganguly

 

বাংলা সাহিত্যের সুবিশাল প্রাঙ্গণে, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (Bibhutibhushan Mukhopadhyay) এক অনন্য স্থান দখল করে আছেন। তিনি সেই বিরল সাহিত্যিকদের একজন, যিনি হাসির নির্মল নির্ঝরের সাথে জীবনের গভীর উপলব্ধি ও মানবিকতার এক অসামান্য মিশ্রণ ঘটাতে পেরেছিলেন। যখনই তাঁর নাম উচ্চারিত হয়, অধিকাংশ পাঠকের মনে ভেসে ওঠে ‘রানু’ সিরিজের সেই ছোট্ট মেয়েটির কৌতুককর কাণ্ডকারখানা অথবা ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর মতো চলচ্চিত্রের দৃশ্য। কিন্তু এই আপাত লঘুতার আড়ালে তাঁর সাহিত্য এক গভীর জীবনবোধ, সহানুভূতি ও মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ। সাহিত্য অকাদেমি (Sahitya Akademi) কর্তৃক পুরস্কৃত এই সাহিত্যিক কেবল হাস্যরসের স্রষ্টা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের একনিষ্ঠ রূপকার। তাঁর রচনা, যা প্রায় এক শতাব্দী ধরে পাঠকদের মুগ্ধ করে রেখেছে, তা নিছক বিনোদন নয়, বরং তা জীবনের এক সহজ, সরল অথচ গভীর পাঠ।

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও কর্ম: এক বিস্তারিত আলোচনা

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাব এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মকে গভীরভাবে বুঝতে হলে, তাঁর বেড়ে ওঠা, কর্মজীবন এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।

প্রারম্ভিক জীবন ও পটভূমি (১৮৯৪ – ১৯২০)

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৪শে অক্টোবর, ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের দ্বারভাঙা জেলার পাণ্ডুল গ্রামে। তাঁর পিতা বনেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন পণ্ডিত এবং পুরোহিত। বিহারের প্রবাসী বাঙালি সমাজে বড় হওয়ার ফলে তাঁর মানসগঠনে এক বিশেষ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা, দুই সংস্কৃতির মধ্যে বসবাসের পর্যবেক্ষণ, তাঁর পরবর্তীকালের সাহিত্যে, বিশেষ করে ভাষার ব্যবহারে ও চরিত্র চিত্রণে, গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় স্থানীয় স্কুলেই। পরবর্তীকালে তিনি পাটনা এবং কলকাতা থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আই.এ. এবং পরে ফিলোসফিতে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। এই শাস্ত্রীয় পড়াশোনা তাঁর লেখনীতে এক ধরণের দার্শনিক গভীরতা যোগ করেছিল, যা তাঁর হাস্যরসের আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকত।

কর্মজীবনের বৈচিত্র্য ও অভিজ্ঞতা (১৯২০ – ১৯৫০)

বিভূতিভূষণের কর্মজীবন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্যই তাঁর সাহিত্যের রশদ জুগিয়েছে। তিনি ভাগলপুরে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি সাংবাদিকতা জগতেও প্রবেশ করেন। তিনি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ‘যুগান্তর’ এবং ‘দৈনিক বসুমতী’-এর মতো প্রখ্যাত সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকতার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাঁর চরিত্রচিত্রণকে আরও বাস্তবসম্মত ও জীবন্ত করে তুলেছিল।

শুধু শিক্ষকতা বা সাংবাদিকতাই নয়, তিনি বিহার সরকারের প্রচার বিভাগে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এই সরকারি চাকরি তাঁকে সাধারণ মানুষের জীবন, আমলাতন্ত্রের জটিলতা এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গঠনকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়। তাঁর গল্প-উপন্যাসে যে বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন মানসিকতার মানুষের ভিড় দেখা যায়, তার উৎস ছিল তাঁর এই বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা।

সাহিত্য জগতে প্রবেশ ও ‘রানু’র সৃষ্টি

বিভূতিভূষণের সাহিত্য জগতে প্রবেশ ঘটে বিশ শতকের বিশের দশকে। তবে তিনি প্রকৃত খ্যাতি অর্জন করেন ১৯৩০-এর দশকে, ‘রানু’ সিরিজের মাধ্যমে। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত ‘রানুর প্রথম ভাগ’ বাংলা শিশুসাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

এর আগে বাংলা শিশুসাহিত্য মূলত রূপকথা, নীতিশিক্ষা অথবা অ্যাডভেঞ্চার কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু বিভূতিভূষণ প্রথমবার এক শিশুর মনস্তাত্ত্বিক জগতকে, তার নিজস্ব যুক্তি, কৌতূহল এবং পৃথিবীকে দেখার ভঙ্গিকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন। ‘রানু’ কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়, সে যেন প্রতিটি বাঙালি পরিবারের আদরের কন্যা। তার ভুল ইংরেজি, সরল জিজ্ঞাসা এবং কৌতুককর পরিস্থিতিগুলো নিছক হাসির খোরাক জোগায় না, বরং তা এক শিশুর বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে সহানুভূতি ও মমতার সাথে চিত্রিত করে। এই সিরিজের অভাবনীয় জনপ্রিয়তা বিভূতিভূষণকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারিতে প্রতিষ্ঠিত করে।

সাহিত্যকীর্তির গভীর বিশ্লেষণ: হাস্যরস থেকে জীবনদর্শনে

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য সম্ভার বিশাল। তিনি প্রায় ৮০টিরও বেশি উপন্যাস এবং শতাধিক ছোটগল্প সংকলন রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যকে কেবল ‘হাস্যরসাত্মক’ বলে চিহ্নিত করা এক ধরণের অসম্পূর্ণ মূল্যায়ন।

উপন্যাস: মধ্যবিত্ত জীবনের সহজ আখ্যান

তাঁর উপন্যাসগুলি মূলত বাঙালি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তিনি জীবনের জটিলতাকে খুব সহজ ও ঘরোয়া ভাষায় উপস্থাপন করতেন।

‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ (১৯৫৮): এক কালজয়ী সৃষ্টি

বিভূতিভূষণের সাহিত্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয় ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ উপন্যাসটি। এই উপন্যাসের জন্যই তিনি ১৯৫৮ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (Sahitya Akademi Award) লাভ করেন।

  • পটভূমি ও বিষয়বস্তু: এই উপন্যাসের পটভূমি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার পরবর্তী সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। এটি একটি ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নয়, বরং এটি দেশপ্রেম, আদর্শবাদ, ত্যাগ এবং মানবিক সম্পর্কের এক জটিল আখ্যান।
  • গভীরতা: উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলি আদর্শ ও বাস্তবের দ্বন্দ্বে দীর্ণ। বিভূতিভূষণ এখানে দেখিয়েছেন যে, রাজনৈতিক আদর্শ বা দেশের প্রতি ভালোবাসার চেয়েও কখনও কখনও মানবিক সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধ অনেক বড় হয়ে ওঠে। “স্বর্গাদপি গরীয়সী” (স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ) – এই নামটিই উপন্যাসের মূল দর্শনকে বহন করে। তিনি এখানে কোনো রাজনৈতিক মতবাদকে বড় করে দেখাননি, বরং দেখিয়েছেন সেই মানুষগুলোকে, যারা এই মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
  • বিশেষত্ব: এই উপন্যাসে তাঁর পরিচিত হাস্যরসের লেশমাত্র নেই। এটি একটি সম্পূর্ণ সিরিয়াস এবং গভীর জীবনবোধের উপন্যাস, যা প্রমাণ করে যে তিনি কেবল লঘু রচনার স্রষ্টা ছিলেন না, বরং জীবনের গভীরতম সংকটগুলিকেও তিনি সমান দক্ষতায় আঁকতে পারতেন।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস

  • ‘নীলাঙ্গুরীয়’ (১৯৪৫): এটি তাঁর আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস, যা পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছিল। এটি এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রেমের কাহিনী। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে, তথাকথিত ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘অস্বাভাবিক’ সম্পর্ককেও তিনি কত সহজে এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে পারেন। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৫০ সালে ‘আনন্দ পুরস্কার’ লাভ করেন।
  • ‘কণ্ঠার মহল’: ভিন্ন স্বাদের এই উপন্যাসে তিনি একাধিক পরিবারের গল্পকে একসূত্রে গেঁথেছেন, যা তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার নিদর্শন।

ছোটগল্প ও অন্যান্য রচনা

ছোটগল্পকার হিসেবেও বিভূতিভূষণ অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘কুশী প্রাঙ্গণের চিঠি’-এর মতো রচনাগুলিতে তাঁর প্রবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা, বিহারের রুক্ষ প্রকৃতি এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ছোটগল্পগুলিতে প্রায়শই এক ধরণের সূক্ষ্ম শ্লেষ (irony) এবং বিষণ্ণতার ছোঁয়া পাওয়া যায়, যা পাঠককে হাসির পরেও ভাবিত করে।

বিভূতিভূষণের সাহিত্যশৈলী: এক স্বতন্ত্র ধারা

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর স্বতন্ত্র গদ্যশৈলী এবং বিষয়বস্তু নির্বাচন।

হাস্যরসের স্বাতন্ত্র্য: সহানুভূতিশীল কৌতুক

বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের বিভিন্ন ধারা বিদ্যমান। রাজশেখর বসু (পরশুরাম)-এর হাস্যরস শাণিত, ব্যঙ্গাত্মক এবং বুদ্ধিদৃপ্ত। শিবরাম চক্রবর্তীর হাস্যরস মূলত শব্দ-কেন্দ্রিক (puns) এবং আত্ম-কৌতুক (self-parody) নির্ভর।

কিন্তু বিভূতিভূষণের হাস্যরস এই দুই ধারার থেকেই আলাদা।

১. তা চরিত্র-নির্ভর: তিনি পরিস্থিতি বা শব্দের মারপ্যাঁচের চেয়ে চরিত্রের অদ্ভুত খেয়াল, তাদের সরলতা বা বোকামি থেকে হাস্যরস সৃষ্টি করতেন।

২. তা সহানুভূতিশীল: বিভূতিভূষণ তাঁর চরিত্রদের নিয়ে উপহাস করেন না, বরং তিনি তাদের প্রতি এক ধরণের মমতা অনুভব করেন। পাঠকও সেই চরিত্রগুলির বোকামিতে হাসে, কিন্তু তাদের ঘৃণা করে না, বরং ভালোবাসে।

৩. তা বাস্তবসম্মত: তাঁর কৌতুক কখনওই অতিরঞ্জিত বা আজগুবি নয়। তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট ভুলভ্রান্তি এবং অসংগতি থেকেই জন্ম নেয়।

ভাষার সারল্য ও গভীরতা

বিভূতিভূষণের ভাষা ছিল নদীর সহজ স্রোতের মতো। তিনি কখনওই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বা জটিল শব্দ ব্যবহার করে পাঠককে ভারাক্রান্ত করতেন না। তাঁর গদ্য ছিল স্বচ্ছ, ঝরঝরে এবং ঘরোয়া। কিন্তু এই সরলতার মধ্যেই তিনি জীবনের অত্যন্ত জটিল দর্শনকে প্রকাশ করতে পারতেন। তাঁর লেখা পড়া শুরু করলে অনায়াসেই শেষ করা যায়, কিন্তু তার রেশ থেকে যায় বহুদিন।

মানবিকতা: তাঁর সাহিত্যের মূল সুর

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সমস্ত সাহিত্যের মূল সুর হলো ‘মানবিকতা’। তিনি মানুষের দোষ-ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁর সাহিত্যে খলনায়কের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। যারা আপাতদৃষ্টিতে ‘খারাপ’, তাদের ভেতরের ভালো দিকটাকেও তিনি অন্বেষণ করতেন। এই গভীর মানবপ্রেমই তাঁকে সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের থেকে পৃথক করেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Calcutta) বাংলা বিভাগের অনেক গবেষণাপত্রে তাঁর এই মানবিক দিকটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।

তুলনামূলক আলোচনা: সমসাময়িকদের ভিড়ে বিভূতিভূষণ

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় যখন লিখছেন, তখন বাংলা সাহিত্যের আকাশ নক্ষত্রখচিত। একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্যদিকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এবং ‘কল্লোল’ যুগের প্রগতিশীল লেখকেরা। এই ভিড়েও তিনি কীভাবে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করলেন, তা লক্ষণীয়।

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বনাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

এই দুই ‘বিভূতিভূষণ’-এর মধ্যে পাঠকদের প্রায়শই বিভ্রান্তি ঘটে। কিন্তু তাঁদের সাহিত্যজগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন।

  • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (পথের পাঁচালী): তাঁর সাহিত্য প্রকৃতি-কেন্দ্রিক, গ্রামীণ জীবন-নির্ভর এবং কাব্যিক (lyrical)। তিনি জীবনের বৃহৎ ক্যানভাসে মানুষের ক্ষুদ্র অস্তিত্বের বিষণ্ণতাকে এঁকেছেন।
  • বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (রানুর প্রথম ভাগ): তাঁর সাহিত্য মূলত শহর বা মফস্বল-কেন্দ্রিক, গার্হস্থ্য জীবনের আখ্যান। তিনি জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আনন্দ, কৌতুক ও অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছেন।

হাস্যরসিক হিসেবে তাঁর স্থান

যেমনটি আগে আলোচনা করা হয়েছে, পরশুরাম বা শিবরামের তুলনায় তাঁর হাস্যরস ছিল অনেক বেশি ঘরোয়া ও মনস্তাত্ত্বিক। তিনি ছিলেন সেই শিল্পী, যিনি সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনের গল্প বলে অসাধারণ সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, মহৎ সাহিত্য রচনার জন্য সবসময় জীবনের বড় বড় ট্র্যাজেডি বা মহান আদর্শের প্রয়োজন হয় না; দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট হাসি-কান্নাও কালজয়ী সাহিত্যের বিষয়বস্তু হতে পারে।

তথ্য ও পরিসংখ্যান: বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক জীবন

বিভূতিভূষণের দীর্ঘ সাহিত্য জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পরিসংখ্যান তাঁর অবদানের গভীরতাকে বুঝতে সাহায্য করে।

বিষয় তথ্য/পরিসংখ্যান উৎস/ব্যাখ্যা
জন্ম ২৪ অক্টোবর, ১৮৯৪ গ্রাম: পাণ্ডুল, দ্বারভাঙা, বিহার
মৃত্যু ৩০ জুলাই, ১৯৮৭ (বয়স ৯২) কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
সাহিত্যকর্ম (আনুমানিক) ৮০টিরও বেশি উপন্যাস; শতাধিক ছোটগল্প সংকলন বিভিন্ন প্রকাশনা (যেমন: আনন্দ পাবলিশার্স, মিত্র ও ঘোষ, দে’জ পাবলিশিং) কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা।
প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘রানুর প্রথম ভাগ’ (১৯৩৭) বাংলা শিশু মনস্তাত্ত্বিক রচনার পথিকৃৎ।
সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ (১৯৫৮) উপন্যাস
প্রধান পুরস্কারসমূহ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮) ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ উপন্যাসের জন্য। (Source: Sahitya Akademi)
আনন্দ পুরস্কার (১৯৫০) ‘নীলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাসের জন্য।
রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৭২) পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সামগ্রিক সাহিত্যের জন্য।
জগত্তারিণী স্বর্ণপদক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত।
সাম্মানিক উপাধি ডি.লিট. (D.Litt) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশিকোত্তম (Desikottama) বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মান।
চলচ্চিত্রায়ণ ‘নীলাঙ্গুরীয়’ (১৯৬০), ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ (১৯৭৩), ‘দম্পতি’ (১৯৮৫) তাঁর গল্প ও উপন্যাসের জনপ্রিয়তার নিদর্শন।

স্বীকৃতি ও উত্তরাধিকার: কেন তিনি আজও প্রাসঙ্গিক

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ জীবনে বহু সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। সাহিত্য অকাদেমি, রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত সাম্মানিক ডি.লিট. বা দেশিকোত্তম তাঁর প্রতিভার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।

কিন্তু তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকার নিহিত আছে সাধারণ পাঠকের মনে। আজও, তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক পরেও, দে’জ পাবলিশিং (Dey’s Publishing) বা মিত্র ও ঘোষের মতো প্রকাশনী থেকে তাঁর বইগুলি নিয়মিত পুনর্মুদ্রিত হয় এবং বেস্টসেলার তালিকায় থাকে। এটি প্রমাণ করে যে, বাঙালি পাঠক মানসিক অবসাদ বা জটিলতার মুহূর্তে আজও তাঁর সাহিত্যের কাছেই আশ্রয় খোঁজে।

তাঁর উত্তরাধিকার এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি বাঙালিকে শিখিয়েছেন কীভাবে জীবনের ছোট ছোট অসংগতিগুলির মধ্যেও আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। তিনি দেখিয়েছেন যে, হাস্যরস কেবল বিনোদন নয়, এটি জীবনকে সহনীয় এবং সুন্দর করে তোলার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে ঘরোয়া হাস্যরসের ধারা (যেমন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখায়) দেখা যায়, তার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়।

উপসংহার

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের সেই উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি লঘুতার আবরণে গভীর জীবনবোধকে পরিবেশন করেছেন। তিনি ‘রানু’র মতো চরিত্রের মাধ্যমে শৈশবের নির্মল জগতকে যেমন অমর করে রেখেছেন, তেমনই ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’-এর মতো উপন্যাসে জাতীয়তাবোধ ও মানবিকতার জটিল দ্বন্দ্বকে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর সাহিত্য পাঠকদের হাসায়, কাঁদায় এবং সর্বোপরি, জীবনের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল ও মমতাময়ী হতে শেখায়। তিনি কেবল একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বা ছোট গল্পকার ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের এক বিশ্বস্ত কথাকার, যাঁর আবেদন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মেও অম্লান থাকবে।

About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।