ভারতীয় সংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর কণ্ঠস্বর, সুর ও সৃজনশীলতা দশকের পর দশক ধরে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে। আসুন জেনে নেই এই কিংবদন্তি শিল্পীর জীবনের নানা অজানা দিক।
প্রারম্ভিক জীবন:
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২০ সালের ১৬ জুন বাংলার বর্ধমান জেলার বেনাচিতি গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন সিতারাম মুখোপাধ্যায় এবং মাতা কুসুমকুমারী। ছোটবেলা থেকেই তিনি সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি প্রথম গান গাইতে শুরু করেন।
সংগীত জগতে প্রবেশ:
১৯৩৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হেমন্ত প্রথম গান রেকর্ড করেন। এটি ছিল সুরকার শৈলেন্দ্র দাসের একটি রচনা। প্রথম দিকে তিনি অনেক সংগ্রাম করেছেন। তবে ধীরে ধীরে তাঁর প্রতিভা স্বীকৃতি পেতে থাকে।
পেশাদার সংগীত জীবনের শুরু:
১৯৪০-এর দশকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পেশাদার গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি সচিন দেব বর্মন, সলিল চৌধুরী প্রমুখ বিখ্যাত সুরকারদের সাথে কাজ করেন। এই সময়ে তিনি নিজস্ব গায়কী শৈলী গঠন করেন, যা পরবর্তীতে ‘হেমন্ত স্টাইল’ হিসেবে পরিচিত হয়।
চলচ্চিত্র জগতে অবদান:
১৯৪৭ সালে ‘অনন্দ মঠ’ ছবিতে প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে হেমন্তের বলিউড অভিষেক ঘটে। এরপর থেকে তিনি হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রে অসংখ্য গান গেয়েছেন। ১৯৫২ সালে ‘আনন্দ ভৈরবী’ ছবিতে সুরকার হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে। এরপর তিনি ‘সহরাই’, ‘নাগিন’, ‘জাগৃতি’ সহ বহু জনপ্রিয় ছবিতে সুর দেন।
ব্যক্তিগত জীবন:
১৯৪৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিয়ে করেন বেলা মুখোপাধ্যায়কে। তাঁদের একমাত্র পুত্র জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়ও একজন সফল গায়ক ও সুরকার। হেমন্ত ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুবৎসল। কিশোর কুমার, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।
শীর্ষে আরোহণ:
১৯৫৫ সালে ‘নাগিন’ ছবির জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ফিল্মফেয়ার সেরা পার্শ্বগায়কের পুরস্কার পান। এরপর তিনি আরও তিনবার এই পুরস্কার জিতেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিও অর্জন করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাঁর গাওয়া ‘জানে ক্যা তুনে কহি’ গানটি সেরা গানের পুরস্কার পায়।
বিভিন্ন ভাষায় গান:
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শুধু বাংলা বা হিন্দিতেই নয়, অসমিয়া, ওড়িয়া, গুজরাটি, মারাঠি, ভোজপুরি, মৈথিলি প্রভৃতি ভাষাতেও গান গেয়েছেন। এর ফলে তিনি সারা ভারতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
উত্তরাধিকার:
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়কী শৈলী পরবর্তী প্রজন্মের অনেক গায়ককে প্রভাবিত করেছে। মুকেশ, মহেন্দ্র কাপুর, মান্না দে প্রমুখ গায়করা তাঁর প্রভাব স্বীকার করেছেন। বাংলা আধুনিক গানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম।
জীবনের শেষ পর্যায়:
জীবনের শেষদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মূলত রেকর্ডিং স্টুডিও পরিচালনা ও নতুন প্রতিভা তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সারা ভারতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
স্মৃতিচারণ ও ঐতিহ্য:
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও কর্ম নিয়ে বহু বই ও গবেষণা হয়েছে। কলকাতায় তাঁর নামে একটি সড়ক আছে। প্রতিবছর তাঁর জন্মদিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবন ছিল সংগীতময়। তিনি শুধু একজন গায়ক নন, একজন সুরকার, প্রযোজক ও শিল্পী হিসেবেও সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট সুর ও কণ্ঠ চিরকাল ভারতীয় সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।