Srijita Chattopadhay
১ জুলাই ২০২৪, ১১:১০ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

DLS: ক্রিকেটে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির জন্ম কাহিনী

ক্রিকেট – যেখানে প্রকৃতির খেয়াল আর মানুষের দক্ষতা একাকার হয়ে যায়। কিন্তু যখন আকাশ মেঘলা হয়, বৃষ্টি নামে মাঠে, তখন এই খেলার গতিপ্রকৃতি পাল্টে যায়। বৃষ্টি বাধাগ্রস্ত ম্যাচে ফলাফল নির্ধারণ চিরকালই ছিল একটি জটিল সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানে যে পদ্ধতি আজ ব্যবহৃত হয়, তার পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

  • প্রাথমিকভাবে, বৃষ্টি বাধাগ্রস্ত ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণে ব্যবহৃত হতো রান রেট পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে দুই দলের প্রতি ওভারে গড় রান হিসাব করে বিজয়ী নির্ধারণ করা হতো। কিন্তু এই পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সরল এবং অনেক ক্ষেত্রেই অন্যায্য। কারণ, এটি বিবেচনা করতো না যে ম্যাচের শেষের দিকে দ্রুত রান করার সুযোগ থাকে।

পরবর্তীতে, ‘মোস্ট প্রডাক্টিভ ওভার’ পদ্ধতি চালু করা হয়। এই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় ইনিংসে বাকি থাকা ওভারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান করা ওভারগুলো বাদ দেওয়া হতো। কিন্তু এই পদ্ধতিও ছিল ত্রুটিপূর্ণ, কারণ এটি বিবেচনা করতো না যে দলের উইকেট হারানোর হার কতটা।

এই সমস্ত সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন দুই ব্রিটিশ গণিতবিদ – ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ এবং টনি লুইস। তারা 1990-এর দশকের শুরুতে একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের কাজ শুরু করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করা, যা শুধু রান রেট নয়, বরং অবশিষ্ট ওভার এবং হারানো উইকেটের সংখ্যাও বিবেচনা করবে।

ডাকওয়ার্থ ও লুইস প্রথমে হাজার হাজার ওয়ানডে ম্যাচের ডেটা বিশ্লেষণ করেন। তারা লক্ষ্য করেন যে ম্যাচের বিভিন্ন পর্যায়ে দলের রান করার হার কীভাবে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, শেষের ওভারগুলোতে দল সাধারণত দ্রুত রান করে, কিন্তু প্রথম দিকে ধীরে ধীরে রান করে। এছাড়া, যত বেশি উইকেট হাতে থাকে, তত বেশি ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ থাকে।

এই সব বিষয় বিবেচনা করে তারা একটি জটিল গাণিতিক মডেল তৈরি করেন। এই মডেলে দুটি প্রধান উপাদান ছিল – ‘রিসোর্সেস রিমেইনিং’ এবং ‘টার্গেট স্কোর’। ‘রিসোর্সেস রিমেইনিং’ হলো একটি দলের অবশিষ্ট ওভার এবং উইকেটের সম্মিলিত মূল্যায়ন। আর ‘টার্গেট স্কোর’ হলো দ্বিতীয় ব্যাটিং দলের জন্য সংশোধিত লক্ষ্য।

1997 সালে, জিম্বাবুয়ে ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার একটি ওয়ানডে ম্যাচে প্রথমবারের মতো ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই ম্যাচে বৃষ্টির কারণে খেলা বাধাগ্রস্ত হলে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। যদিও প্রথম দিকে অনেকেই এই পদ্ধতিকে জটিল মনে করেছিলেন, কিন্তু ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব ও কার্যকারিতা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

2001 সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (ICC) ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়। এর ফলে বিশ্বের সব প্রধান ক্রিকেট টুর্নামেন্টে এই পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হয়। 2003 সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে এই পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, যা এর গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়ে দেয়।

তবে সময়ের সাথে সাথে এই পদ্ধতিরও কিছু সীমাবদ্ধতা প্রকাশ পায়। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আগমনের পর, যেখানে খেলার গতি অনেক দ্রুত, সেখানে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি সবসময় সঠিক ফলাফল দিতে পারছিল না।

এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন অস্ট্রেলীয় গণিতবিদ স্টিভেন স্টার্ন। তিনি ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিকে আরও উন্নত করেন, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের জন্য। তার সংশোধনীগুলো 2009 সালে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং নতুন পদ্ধতির নাম হয় ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন (DLS) পদ্ধতি।

DLS পদ্ধতি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এটি ক্রিকেটে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই পদ্ধতি শুধু বৃষ্টি বাধাগ্রস্ত ম্যাচেই নয়, অন্যান্য কারণে বাধাগ্রস্ত ম্যাচেও ব্যবহৃত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, 2019 সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে, যখন ম্যাচ টাই হয়ে সুপার ওভারেও সমান রান হয়, তখন DLS পদ্ধতি ব্যবহার করে ইংল্যান্ডকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

যদিও DLS পদ্ধতি বর্তমানে সর্বোত্তম সমাধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তবুও এর উন্নয়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ক্রিকেটের নিয়ম ও খেলার ধরন পরিবর্তনের সাথে সাথে এই পদ্ধতিও নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহার এই পদ্ধতিকে আরও নির্ভুল ও ন্যায্য করে তুলতে পারে।

শেষ পর্যন্ত, ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতি শুধু একটি গাণিতিক ফর্মুলা নয়, এটি ক্রিকেটে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে যে কীভাবে বিজ্ঞান ও গণিত খেলাধুলার জগতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারে। যতদিন ক্রিকেট থাকবে, ততদিন এই পদ্ধতির প্রভাব অনুভূত হবে, আর তার সাথে স্মরণ করা হবে সেই দূরদর্শী গণিতবিদদের, যারা এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঊর্ধ্বগতি: রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় ছাত্রদের

ভারতে ইন্টারনেট বিপ্লবের নতুন দিগন্ত: স্টারলিঙ্কের সঙ্গে এয়ারটেলের ঐতিহাসিক চুক্তি

অস্ত্র আমদানির দৌড়ে শীর্ষে ইউক্রেন, ভারতের স্থান দ্বিতীয়: বিশ্বে কী বার্তা?

মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে নজর! বঙ্গের সব আসনে লড়তে প্রস্তুত আইএমআইএম

হোলির রঙে ব্যাঙ্ক বন্ধ: আগামীকাল থেকে টানা ৪ দিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাঙ্ক ছুটি, তালিকা দেখে নিন

কেকেআরের প্রস্তুতি শুরু: কলকাতায় নাইটদের ক্যাপ্টেন-কোচের সঙ্গে প্রকাশিত হল প্র্যাক্টিস সূচি

শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে ‘ক্রিমিনাল’ পোস্টার: সিপিএম নেতার থানায় তলব!

কলকাতার Zakaria Street-এর মাস্ট ভিজিট ফুড স্টল: একটি খাদ্যপ্রেমীর স্বর্গভূমি

অলক্ষ্যে ঋত্বিক: ঋত্বিক ঘটকের জীবনালেখ্য নিয়ে আসছে বাঙালির প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র

আইপিএল-এ তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধ! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কড়া নির্দেশ জারি!

১০

দেওয়ালের কোন দিকে কোন রঙ শুভ? বাস্তুশাস্ত্রের চোখে একটি গভীর দৃষ্টিপাত

১১

ডিএলএফ-এমআরএফ-আমূল-পেটিএম: সংক্ষিপ্ত নামেই ভারত বিখ্যাত, এবার জেনে নিন এই ব্র্যান্ডগুলোর পুরো নাম!

১২

সেক্সসমনিয়া: ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিরল রহস্য

১৩

ভীষণ ক্ষতিকর Non-Stick প্যানে রান্না করছেন না তো? জেনে নিন সেরা বিকল্পগুলো

১৪

কাক ডাকার ফলাফল: ইসলাম ও হিন্দু শাস্ত্রে কী বলা আছে?

১৫

দিনে ৮ ঘণ্টা AC চালালে মাসে কত ‘Electric Bill’ আসবে? সহজ হিসেবে নিশ্চিন্তে থাকুন

১৬

প্রাক্তনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কি বুদ্ধিমানের কাজ? একটি গভীর বিশ্লেষণ

১৭

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের জাদু: কীভাবে ভারত হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য?

১৮

বাংলার প্রথম এসি লোকাল ট্রেন শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর রুটে, ভাড়া কত জানেন?

১৯

ভারতে রাজ্যভিত্তিক হীরার মজুদ: কোন রাজ্য হীরা উৎপাদনে সেরা?

২০
close