ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন বিতর্ক দানা বেঁধেছে, যেখানে বিরোধী দলের নেতারা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেই তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ এবং তদন্তের গতিপ্রকৃতি আশ্চর্যজনকভাবে বদলে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই ২৩ জন বিরোধী নেতার নাম, যাঁরা বিজেপিতে যোগদানের আগে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই (CBI), ইডি (ED) বা আয়কর দফতরের (Income Tax Department) মতো সংস্থার নজরে ছিলেন। কিন্তু দল বদলের পরেই সেই সব মামলা হয় ধামাচাপা পড়েছে, নয়তো তদন্তের গতি শ্লথ হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এবং তদন্তকারী সংস্থাকে ‘ওয়াশিং মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ তুলেছে।
এই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা ঘটনাটি কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে ঘটেনি, বরং গত কয়েক বছর ধরে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিরোধী নেতারা, যাঁদের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ ছিল, তাঁরা বিজেপির পতাকা হাতে তুলে নেওয়ার পরেই যেন এক অদৃশ্য রক্ষাকবচ পেয়ে যাচ্ছেন। এই নেতাদের তালিকায় রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের শুভেন্দু অধিকারী, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ারের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা। বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তের চাপ সৃষ্টি করে এবং পরে দলে যোগদানের পুরস্কার হিসেবে তাঁদের মামলা থেকে নিষ্কৃতি দেয়।
তদন্তের গতিপথ পরিবর্তনের এই প্রবণতা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের সারদা এবং নারদা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর। তৃণমূল কংগ্রেসে থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির শীর্ষ নেতারা লাগাতার আক্রমণ শানিয়েছেন। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে চলা তদন্তের আর কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি। একই চিত্র দেখা গিয়েছে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ক্ষেত্রেও। কংগ্রেস থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে লুই বার্জার এবং সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছিল খোদ বিজেপি। কিন্তু ২০১৫ সালে তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সেই সব অভিযোগ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।
সাম্প্রতিককালে মহারাষ্ট্রের রাজনীতি এই বিতর্কের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে। এনসিপি নেতা অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবল এবং হাসান মু মিনিটের মতো নেতাদের বিরুদ্ধে ইডি এবং রাজ্য পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ দমন শাখা একাধিক দুর্নীতির মামলায় তদন্ত চালাচ্ছিল। মহারাষ্ট্র রাজ্য সমবায় ব্যাংক (MSC Bank) দুর্নীতি মামলায় অজিত পাওয়ারের নাম জড়িয়েছিল এবং তাঁর বেশ কিছু সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করেছিল ইডি। কিন্তু ২০২৩ সালে তিনি তাঁর অনুগামী বিধায়কদের নিয়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মহারাষ্ট্র সরকারে যোগ দেওয়ার পরেই পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। যে মামলায় ইডি তাঁকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে দেখছিল, সেই মামলাতেই তারা আদালতে জানায় যে, এই দুর্নীতির জন্য অজিত পাওয়ারকে দায়ী করা যায় না। একইভাবে, হাসান মু মিনিটের বিরুদ্ধে চিনিকল দুর্নীতি এবং ছগন ভুজবলের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র সদন দুর্নীতি মামলার তদন্তও কার্যত থেমে গিয়েছে।
এই তালিকায় আরও অনেক নাম রয়েছে, যেমন—নারায়ণ রাণে, যিনি কংগ্রেসে থাকাকালীন অর্থপাচারের অভিযোগে ইডির নজরে ছিলেন, কিন্তু বিজেপিতে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের আর কোনো খবর নেই। কর্ণাটকের প্রভাবশালী খনি ব্যবসায়ী জনার্দন রেড্ডির বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ খনি দুর্নীতির অভিযোগ ছিল এবং সিবিআই তাঁকে গ্রেফতারও করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বিজেপির কাছাকাছি আসতেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দুর্বল হতে শুরু করে। এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট কৌশলের অংশ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এই অভিযোগের জবাবে বিজেপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে যে, দেশের তদন্তকারী সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং আইন আইনের পথেই চলে। তাঁদের মতে, কোনো নেতার বিরুদ্ধে মামলা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে দলে নেওয়া হয়েছে কারণ যতক্ষণ না কেউ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ তাঁকে নির্দোষ হিসেবেই গণ্য করা উচিত। বিজেপির মুখপাত্ররা প্রায়শই দাবি করেন যে, বিরোধীরা নিজেদের দুর্নীতি ঢাকতেই এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলে। তাঁদের আরও যুক্তি, অনেক মামলা দীর্ঘ সময় ধরে চলে এবং তদন্ত শেষ হতে সময় লাগে। এর সঙ্গে দল বদলের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে বিরোধী দলগুলো বিজেপির এই যুক্তি মানতে নারাজ। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, এনসিপি (শরদ পওয়ার গোষ্ঠী), এবং শিবসেনা (উদ্ধব ঠাকরে গোষ্ঠী)-র মতো দলগুলো একযোগে অভিযোগ করেছে যে, বিজেপি শুধুমাত্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিরোধী নেতাদের ভয় দেখাচ্ছে না, বরং গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত তদন্তকারী সংস্থাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাও নষ্ট করে দিচ্ছে। তাঁদের মতে, এই সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে বিরোধী শিবিরে থাকাটা একপ্রকার অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই প্রবণতা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করছেন তাঁরা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, এই ঘটনা ভারতীয় রাজনীতির এক নতুন এবং উদ্বেগজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অতীতেও দল বদলের রাজনীতি বা মামলা প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটলেও, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে এত ব্যাপকভাবে এবং এত সুপরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ আগে কখনো ওঠেনি। এর ফলে সাধারণ মানুষের মনে আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যখন একজন নেতার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর রাজনৈতিক আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়, তখন তা বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েই বড়সড় প্রশ্ন তুলে দেয়। এই বিতর্কের জল আগামী দিনে আরও কতদূর গড়ায় এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপর এর কী প্রভাব পড়ে, সেটাই এখন দেখার। বিজেপিতে যোগ দিয়েই দোষমুক্ত বিরোধী নেতাদের এই তালিকা দীর্ঘতর হলে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অশনি সংকেত।