BJP anti-Bengali politics: ভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালি পরিচয় নিয়ে নতুন বিতর্ক দেখা দিয়েছে। বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল এবং তাদের ভাষানীতির কারণে দেশজুড়ে বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হচ্ছে। সম্প্রতি অসমে বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদের প্রতি সরকারি দমনমূলক মনোভাবের অভিযোগে সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন উঠেছে – কেন বিজেপি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি এমন অবস্থান নিয়েছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির মূল সমস্যা হলো তাদের উত্তর ভারতীয় হিন্দু-হিন্দিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। এই দলটি সারাদেশে হিন্দি ভাষার প্রচার ও প্রসারে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করে যাচ্ছে, যা পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত দশ বছরে বিজেপি সংস্কৃত ভাষার প্রসারে অন্যান্য সব ভাষার তুলনায় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করেছে, যা আঞ্চলিক ভাষাগুলোর প্রতি তাদের উদাসীনতার প্রমাণ।
BJP Leader: মোদির পর কে? বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে
এর ফলাফল হিসেবে দক্ষিণ ভারতের পাশাপাশি এখন পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলোতেও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদও এর ব্যতিক্রম নয়। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, যার মধ্যে ‘বাংলা পক্ষ’ প্রধান। গত কয়েক বছরে তাদের জনপ্রিয়তা ভালো রকম বেড়েছে এবং জেলায় জেলায় তৈরি হয়েছে তাদের অফিস।
বিজেপির এই কৌশলের পেছনে রয়েছে জনতাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশ। হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে জনসংখ্যার হার দক্ষিণ বা পূর্ব ভারতের থেকে বেশি থাকায় ভবিষ্যতে লোকসভা আসনের সংখ্যা সেখানে বাড়বে। এতে বিজেপির লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তর প্রদেশ, বিহার বা ঝাড়খন্ডের অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্যের কারণে সেখান থেকে হিন্দিভাষী শ্রমিক বিরাট সংখ্যায় অ-হিন্দিভাষী ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাজ্যে কাজ করতে যান। এভাবে তারা সেই রাজ্যের জনবিন্যাস ধীরে ধীরে পাল্টে দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গেও অবাঙালি ভোট বাড়ছে এবং বিজেপি জানে, এই হিন্দিভাষী ভোট তাদের।
অন্যদিকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ বিজেপির একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। দলটি বাংলাদেশ থেকে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের শরণার্থী এবং মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দেয়। গবেষক মাইকেল গিলানের মতে, এর মাধ্যমে বিজেপি যেসব অঞ্চলে দল ঐতিহাসিকভাবে সফল নয়, সেই সব অঞ্চলে হিন্দু আবেগকে কাজে লাগাতে চায়। সাম্প্রতিক ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনেও বিজেপি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাঙালি পরিচয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। অনেক সময় ‘বাঙালি মানেই বাংলাদেশী’ এমন একটি ধারণা প্রচারিত হয়, যা মূলত বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে আসে। এর ফলে ভারতীয় বাঙালিরাও সন্দেহের চোখে দেখা হয়, বিশেষ করে অসম ও অন্যান্য রাজ্যে। সম্প্রতি অসমে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের উপর ‘ভাষাগত নিপীড়ন’-এর অভিযোগে সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বঙ্গের ভোট ময়দানে বিজেপির অবস্থান নিয়ে হাজার একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে
ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছিল পূর্ব বাংলা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বিজেপির রাজনীতি এই পরিচয়কে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সন্দেহের বৃত্তে ফেলে দিয়েছে।
প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো, বিজেপির এই নীতির কারণে তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে তাদের জয় এক প্রকার নিশ্চিত বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিজেপিই কার্যত তা নিশ্চিত করেছে তাদের ভুল কৌশলের মাধ্যমে।
বস্তুত বিজেপির বাঙালি এলার্জি আসলে তাদের সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ফসল। এই দল বাংলার ত্রিশ শতাংশ সংখ্যালঘুর ভোট পেতে আগ্রহী নয়, বরং হিন্দুত্ব হাতছাড়া করলে কোথাও জিততে পারবে না বলেই মনে করে। ফলে বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি তাদের বৈরিতা অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।