ব্ল্যাক বক্স: বিমানের অদৃশ্য সাক্ষী, দুর্ঘটনার আসল কারণের সন্ধানদাতা

black box flight recorder: একটি বিমান যখন আকাশে উড়ে, তখন তার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নীরবে রেকর্ড হতে থাকে একটি যন্ত্রে—যার নাম ‘ব্ল্যাক বক্স’ (Black Box)। বিমান দুর্ঘটনার পর যখন গোটা বিশ্ব স্তব্ধ, তখন তদন্তকারীদের একটাই লক্ষ্য—ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পাওয়া। কারণ, এই ছোট্ট যন্ত্রেই লুকিয়ে থাকে দুর্ঘটনার আসল রহস্যের চাবিকাঠি। আজকের ব্লগে আমরা জানব, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ‘ব্ল্যাক বক্স’, কীভাবে কাজ করে, আর কী দিয়েই বা তৈরি এই যন্ত্র।

ব্ল্যাক বক্স (Black Box) কী?

ব্ল্যাক বক্স—নাম শুনে অনেকেই ভাবেন, এটি বুঝি কালো রঙের কোনো বাক্স। কিন্তু বাস্তবে, এটি উজ্জ্বল কমলা বা লাল রঙের হয়, যাতে দুর্ঘটনার পরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। এর আসল নাম ‘ফ্লাইট রেকর্ডার’ (Flight Recorder)। প্রতিটি বাণিজ্যিক বিমানে দুটি প্রধান ব্ল্যাক বক্স থাকে—

• ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (Flight Data Recorder – FDR): বিমানের গতি, উচ্চতা, অবস্থান, ইঞ্জিন পারফরম্যান্স, ফ্লাইট রুট সহ প্রযুক্তিগত ডেটা রেকর্ড করে।
• ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (Cockpit Voice Recorder – CVR): ককপিটে পাইলট ও সহ-পাইলটের মধ্যে হওয়া কথোপকথন ও আশপাশের শব্দ রেকর্ড করে।

কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ব্ল্যাক বক্স?

বিমান দুর্ঘটনার পর তদন্তকারীদের প্রথম কাজ হয় ব্ল্যাক বক্সের সন্ধান করা। কারণ, এই যন্ত্রের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে দুর্ঘটনার আসল কারণ জানার সূত্র। বিমানের প্রযুক্তিগত ত্রুটি, পাইলটের ভুল, আবহাওয়ার সমস্যা, কিংবা অন্য কোনো অজানা কারণ—সবকিছুই ধরা পড়ে ব্ল্যাক বক্সের তথ্য বিশ্লেষণে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক ব্ল্যাক বক্সে প্রায় ২৫ ঘণ্টা পর্যন্ত বিমানের ফ্লাইট ডেটা এবং শেষ ২ ঘণ্টার ককপিটের কথোপকথন সংরক্ষিত থাকে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করেই তদন্তকারীরা জানতে পারেন, দুর্ঘটনার ঠিক আগে কী ঘটেছিল।

ব্ল্যাক বক্স কীভাবে কাজ করে?

ব্ল্যাক বক্স বিমানের ওড়ার মুহূর্ত থেকে অবতরণের শেষ পর্যন্ত প্রতিটি তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করে রাখে।

• FDR (Flight Data Recorder): বিমানের গতি, উচ্চতা, জ্বালানি, টার্বুলেন্স, কেবিনের চাপ, ইঞ্জিনের অবস্থা—সব তথ্য অটোমেটিক সেন্সরের মাধ্যমে সংগ্রহ করে।
• CVR (Cockpit Voice Recorder): ককপিটের বিভিন্ন মাইক্রোফোনের মাধ্যমে পাইলট, কো-পাইলট, কেবিন ক্রুদের কথোপকথন, অ্যালার্ম, ইঞ্জিনের আওয়াজ, ককপিটের আশপাশের শব্দ রেকর্ড করে।
  ব্ল্যাক বক্সের তথ্য সাধারণত বিমানের পিছনের দিকে থাকা অংশে সংরক্ষিত থাকে, কারণ দুর্ঘটনার সময় এই অংশটি তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ব্ল্যাক বক্সের গঠন ও টেকসইত্ব

ব্ল্যাক বক্স তৈরি হয় টাইটানিয়াম বা স্টেইনলেস স্টিলের মতো অত্যন্ত শক্তিশালী ও উচ্চতাপ সহনশীল ধাতু দিয়ে।

• এটি ১১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১ ঘণ্টা পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারে।
• ৩৪০০-জি (G-force) অর্থাৎ পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলের ৩৪০০ গুণ চাপ সহ্য করতে পারে।
• ২০,০০০ ফুট গভীর সমুদ্রের পানির চাপেও এটি নষ্ট হয় না।
• ব্ল্যাক বক্সে থাকে আন্ডারওয়াটার লোকেটর বিকন (Underwater Locator Beacon – ULB), যা পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংকেত পাঠাতে শুরু করে এবং ৩০ দিন পর্যন্ত প্রতি সেকেন্ডে একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের শব্দ তরঙ্গ পাঠায়। ফলে গভীর সমুদ্র থেকেও এটি উদ্ধার করা সম্ভব।

ব্ল্যাক বক্সের ইতিহাস ও বিবর্তন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ ধরনের যন্ত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও, ১৯৫০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী ডেভিড ওয়ারেন আধুনিক ব্ল্যাক বক্সের ধারণা দেন। ১৯৬২ সালে প্রথমবার একটি বিমানে পরীক্ষামূলকভাবে ব্ল্যাক বক্স ব্যবহার করা হয়।
প্রথমদিকে ডিভাইসটি লাল রঙের ছিল এবং ‘রেড এগ’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এর ভিতরের দেয়াল কালো রঙের হওয়ায় ‘ব্ল্যাক বক্স’ নামটি জনপ্রিয় হয়।

ব্ল্যাক বক্সের তথ্য কীভাবে উদ্ধার ও বিশ্লেষণ করা হয়?

বিমান দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকারীরা দ্রুত ব্ল্যাক বক্স খোঁজেন। উদ্ধার করার পর বিশেষজ্ঞরা অত্যাধুনিক যন্ত্র ও সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য ডিকোড করেন।

• তদন্তকারীরা বিমানের প্রযুক্তিগত তথ্য, ককপিটের কথোপকথন, ইঞ্জিনের শব্দ, অ্যালার্ম, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ডেটা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার আসল কারণ বের করেন।
• কখনও কখনও ব্ল্যাক বক্সের ক্ষতি হলে তথ্য উদ্ধার করতে মাসের পর মাস সময় লাগতে পারে। কারণ, মেমোরি চিপগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল।

ব্ল্যাক বক্স ছাড়া কি সম্ভব দুর্ঘটনার কারণ জানা?

ব্ল্যাক বক্স ছাড়া বিমান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা প্রায় অসম্ভব। কারণ, এই যন্ত্র ছাড়া বিমানের শেষ মুহূর্তের প্রযুক্তিগত ও মানবিক তথ্যের কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস থাকে না। তাই, আধুনিক এভিয়েশন নিরাপত্তায় ব্ল্যাক বক্স এক অনিবার্য উপাদান।

ব্ল্যাক বক্স (Black Box) শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি আকাশপথের নিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ। দুর্ঘটনার পর যখন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়, তখনও ব্ল্যাক বক্স নীরবে সাক্ষ্য দেয়—বিমানের শেষ মুহূর্তের প্রতিটি তথ্য, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সংকেত। এই তথ্য বিশ্লেষণ করেই ভবিষ্যতের জন্য আরও নিরাপদ আকাশপথ নিশ্চিত করা যায়। তাই, ব্ল্যাক বক্সের গুরুত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না—এটি বিমানের অদৃশ্য সাক্ষী, দুর্ঘটনার আসল কারণের সন্ধানদাতা।আপনার মতামত, প্রশ্ন বা মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না। নিরাপদ থাকুন, সচেতন থাকুন!