সকালে খালি পেটে লিকার চা: অ্যাসিডিটির ঝুঁকি কতটা? জানুন বিশেষজ্ঞের মতামত

​অনেকেরই দিন শুরু হয় এক কাপ গরম কালো চা দিয়ে। এটি কেবল ক্লান্তি দূর করে না, সাথে সাথে শরীরকে চনমনে করে তোলে। কিন্তু একটি প্রশ্ন প্রায়শই ওঠে - সকালে, বিশেষ…

Debolina Roy

 

​অনেকেরই দিন শুরু হয় এক কাপ গরম কালো চা দিয়ে। এটি কেবল ক্লান্তি দূর করে না, সাথে সাথে শরীরকে চনমনে করে তোলে। কিন্তু একটি প্রশ্ন প্রায়শই ওঠে – সকালে, বিশেষ করে খালি পেটে কালো চা পান করলে কি অ্যাসিডিটি বা গ্যাস-অম্বলের সমস্যা হতে পারে? এই প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কারণ ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ নিয়মিত এই সমস্যায় ভুগে থাকেন। আসুন, এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

​লিকার চা এবং অ্যাসিডিটির সম্পর্ক

​কালো চা সামান্য অম্লীয় বা অ্যাসিডিক প্রকৃতির। এর pH মাত্রা সাধারণত ৪.৯ থেকে ৫.৫-এর মধ্যে থাকে। যে কোনও পানীয়ের pH মাত্রা ৭-এর কম হলে তাকে অ্যাসিডিক বলে গণ্য করা হয়। কালো চায়ের মধ্যে থাকা ক্যাফেইন এবং ট্যানিন নামক যৌগ পাকস্থলীতে অ্যাসিডের ক্ষরণ বাড়িয়ে তুলতে পারে।

  • ক্যাফেইন: ক্যাফেইন আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে, যা আমাদের সজাগ থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু এর পাশাপাশি, এটি পাকস্থলীর গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের উৎপাদনকেও উৎসাহিত করে। খালি পেটে ক্যাফেইন প্রবেশ করলে, এই অ্যাসিড পাকস্থলীর ভেতরের আস্তরণে অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
  • ট্যানিন: ট্যানিন হলো এক ধরণের পলিফেনল যা চায়ের কষা স্বাদের জন্য দায়ী। এই যৌগটিও পাকস্থলীতে অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার ফলে পেট ফাঁপা, বুক জ্বালা এবং অস্বস্তি দেখা দিতে পারে।

​যখন আমরা খালি পেটে কালো চা পান করি, তখন পাকস্থলীতে অন্য কোনও খাবার না থাকায় এই অ্যাসিড সরাসরি পাকস্থলীর প্রাচীরের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে অ্যাসিডের প্রভাব আরও তীব্রভাবে অনুভূত হয় এবং অ্যাসিডিটির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

​ভারতে অ্যাসিডিটির প্রকোপ: একটি উদ্বেগজনক চিত্র

​গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) বা সাধারণ ভাষায় অ্যাসিডিটির সমস্যা ভারতে ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৭.৬% থেকে ৩০% মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ এবং ধূমপানের মতো বিষয়গুলি এর প্রধান কারণ হলেও, পানীয়ের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সকালে খালি পেটে চা বা কফি পানের অভ্যাস অনেকের মধ্যেই এই সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে।

​বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরাঞ্চলে এই রোগের প্রকোপ গ্রামের তুলনায় বেশি। এর কারণ হলো শহরের মানুষের জীবনযাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি तनावपूर्ण এবং তাদের খাদ্যাভ্যাসে প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিমাণ বেশি।

​লিকার চায়ের রাসায়নিক উপাদান এবং তার প্রভাব

​কালো চায়ের অ্যাসিডিটির কারণ আরও ভালোভাবে বুঝতে হলে এর রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

  • ক্যাফেইনের পরিমাণ: বিভিন্ন ধরণের কালো চায়ে ক্যাফেইনের পরিমাণ ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, আসাম চায়ে ক্যাফেইনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, যেখানে দার্জিলিং চায়ে এর পরিমাণ কিছুটা কম। এক কাপ (প্রায় ২৪০ মিলি) কালো চায়ে সাধারণত ৪০ থেকে ৭০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। তুলনামূলকভাবে, এক কাপ কফিতে এর পরিমাণ প্রায় ৯০ থেকে ১৪০ মিলিগ্রাম।
  • ট্যানিনের পরিমাণ: চা যত বেশি সময় ধরে ফোটানো হয়, ট্যানিনের পরিমাণ তত বাড়তে থাকে। কড়া লিকারের চায়ে ট্যানিনের মাত্রা বেশি হওয়ায় অ্যাসিডিটির ঝুঁকিও বেশি থাকে।

​কখন এবং কীভাবে লিকার চা পান করলে অ্যাসিডিটির ঝুঁকি কমবে?

​সকালে কালো চা পান করা মানেই যে অ্যাসিডিটি হবে, তা কিন্তু নয়। কিছু নিয়ম মেনে চললে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

  • খালি পেটে নয়: ঘুম থেকে ওঠার পরেই খালি পেটে চা পান করার অভ্যাস ত্যাগ করুন। চা পানের আগে হালকা কিছু খেয়ে নিন, যেমন এক বা দুটি বিস্কুট, এক মুঠো বাদাম বা এক গ্লাস জল। এটি পাকস্থলীতে একটি আস্তরণ তৈরি করে যা অ্যাসিডের সরাসরি প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
  • হালকা লিকার: খুব কড়া লিকারের চা এড়িয়ে চলুন। চায়ের পাতা কম পরিমাণে ব্যবহার করুন এবং অল্প সময় ধরে ফোটান। এতে ট্যানিনের পরিমাণ কম থাকবে।
  • দুধের ব্যবহার: কালো চায়ের সাথে সামান্য দুধ মিশিয়ে নিলে এর অ্যাসিডিটি কিছুটা কমে। দুধের pH মাত্রা প্রায় ৬.৭ থেকে ৬.৯, যা চায়ের অম্লত্বকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে।
  • লেবু এবং চিনি: চায়ে অতিরিক্ত লেবু বা চিনি মেশানো থেকে বিরত থাকুন। লেবুতে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড অ্যাসিডিটির সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
  • পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ: দিনে ২-৩ কাপের বেশি কালো চা পান না করাই ভালো। অতিরিক্ত পরিমাণে চা পান করলে শরীরে ক্যাফেইনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা অ্যাসিডিটির পাশাপাশি ঘুমের সমস্যা এবং উদ্বেগের কারণও হতে পারে।

​লিকার চায়ের উপকারিতা

​অ্যাসিডিটির ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, পরিমিত পরিমাণে এবং সঠিক উপায়ে কালো চা পান করলে এর অনেক স্বাস্থ্যকর দিকও রয়েছে।

  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর: কালো চায়ে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিশেষ করে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং শরীরের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
  • হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য: নিয়মিত কালো চা পান করলে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL)-এর মাত্রা কমে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
  • হজমে সহায়ক: কিছু ক্ষেত্রে, খাবার খাওয়ার পর হালকা লিকারের কালো চা হজমে সাহায্য করতে পারে।
  • মানসিক সতর্কতা: ক্যাফেইন মানসিক সতর্কতা এবং মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।

​প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

প্রশ্ন: লিকার চা কি কফির চেয়ে বেশি অ্যাসিডিক?

উত্তর: না, সাধারণত কালো চা কফির চেয়ে কম অ্যাসিডিক। কফির pH মাত্রা ৪.৮৫ থেকে ৫.৫-এর মধ্যে থাকে, যেখানে কালো চায়ের pH ৪.৯ থেকে ৫.৫। তবে, বানানোর পদ্ধতির উপর এর তারতম্য হতে পারে।

প্রশ্ন: কোন ধরণের চা অ্যাসিডিটির জন্য সবচেয়ে ভালো?

উত্তর: যাদের অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে, তাদের জন্য ভেষজ চা (Herbal Tea) যেমন আদা চা, ক্যামোমাইল চা বা মৌরি চা বেশি উপকারী। এই চাগুলিতে ক্যাফেইন থাকে না এবং এগুলি হজমে সাহায্য করে।

প্রশ্ন: সকালে খালি পেটে লিকার চায়ের বদলে কী পান করা যেতে পারে?

উত্তর: সকালে দিন শুরু করার জন্য ঈষদুষ্ণ জল, লেবু ও মধুর মিশ্রণ, ডাবের জল অথবা কোনও ফলের রস অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হতে পারে।

প্রশ্ন: দুধ চা খেলে কি গ্যাস হতে পারে?

উত্তর: অনেকেরই দুধ চা খেলে গ্যাস বা পেট ফাঁপার সমস্যা হয়। এর কারণ হলো দুধে থাকা ল্যাকটোজ এবং চায়ের ট্যানিন একসাথে মিশে হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে। যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে, তাদের এই সমস্যা বেশি হয়।

প্রশ্ন: লিকার চা কি ওজন কমাতে সাহায্য করে?

উত্তর: কালো চায়ে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড বিপাক প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে পারে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। তবে শুধুমাত্র চা পান করে ওজন কমানো সম্ভব নয়, এর জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরচর্চা প্রয়োজন।

​শেষ কথা

​সকালে কালো চা পান করা অনেকেরই একটি প্রিয় অভ্যাস। পরিমিত পরিমাণে এবং সঠিক নিয়ম মেনে চললে এর স্বাস্থ্যকর উপকারিতাগুলি উপভোগ করা সম্ভব। তবে, যাদের নিয়মিত অ্যাসিডিটি বা গ্যাস-অম্বলের সমস্যা রয়েছে, তাদের সকালে খালি পেটে কালো চা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। নিজের শরীরের প্রতি মনোযোগ দিন এবং কোনও রকম অস্বস্তি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে ছোট ছোট পরিবর্তন এনেই বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকা সম্ভব।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।