Blood tests without needles: আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আসতে চলেছে। সুচ ছাড়াই হবে রক্ত পরীক্ষা? – এই প্রশ্নের উত্তর এখন আর কল্পনার বিষয় নয়, বরং বাস্তবতা। ঐতিহ্যগত সূঁচের মাধ্যমে রক্ত নেওয়ার যন্ত্রণা এবং ভয় থেকে মুক্তি পেতে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন একাধিক উন্নত প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে শুরু করে লেজার প্রযুক্তি পর্যন্ত – বিভিন্ন উপায়ে এখন সূঁচ ছাড়াই রক্ত পরীক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠেছে। ভারতেও এই প্রযুক্তির সূচনা হয়েছে, যা চিকিৎসা সেবায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
কী এই সুচ ছাড়াই হবে রক্ত পরীক্ষা প্রযুক্তি?
নিডল-ফ্রি বা সূঁচবিহীন রক্ত পরীক্ষা প্রযুক্তি হল এমন একটি উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে ঐতিহ্যগত সূঁচ এবং সিরিঞ্জের প্রয়োজন হয় না। এই প্রযুক্তি বিভিন্ন উপায়ে কাজ করে – কখনো মুখমণ্ডল স্ক্যান করে, কখনো লেজার ব্যবহার করে, আবার কখনো ত্বকের মাধ্যমে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে।
এই পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হল রোগীদের যন্ত্রণা কমানো এবং সূঁচের ভয় দূর করা। বিশেষত শিশু এবং সূঁচভীতি রোগীদের জন্য এই প্রযুক্তি আশীর্বাদস্বরূপ। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রাপ্তবয়স্কদের ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ সূঁচের ভয়ে ভোগেন।
ভারতে সুচ ছাড়াই হবে রক্ত পরীক্ষার অগ্রগতি
ভারতে এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে হায়দরাবাদে। নিলুফার হাসপাতাল ভারতের প্রথম হাসপাতাল হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক সূঁচবিহীন রক্ত পরীক্ষার যন্ত্র চালু করেছে। “অমৃত স্বাস্থ্য ভারত” নামের এই যন্ত্রটি হেলথ-টেক স্টার্টআপ কুইক ভাইটালস তৈরি করেছে।
এই অত্যাধুনিক যন্ত্রটি মুখমণ্ডল স্ক্যান করার মাধ্যমে মাত্র ২০ থেকে ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে রক্ত পরীক্ষার ফলাফল দিতে পারে। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের ক্যামেরা ব্যবহার করে এই পরীক্ষা সম্পন্ন হয়, যা চিকিৎসা সেবায় এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এনেছে।
বিভিন্ন প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ফেস স্ক্যানিং
হায়দরাবাদে চালু হওয়া সিস্টেমটি ফেস স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে একটি বিশেষ অ্যালগরিদম মুখের রঙ, তাপমাত্রা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে রক্তের বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণ করে। এই প্রযুক্তি বিশেষভাবে দুর্গম এলাকায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে সহায়ক।
লেজার প্রযুক্তি
আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্ররা রক্তকণিকার বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে একটি অনন্য প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন। এই যন্ত্রটি লেজার ব্যবহার করে বিশেষত নিচের ঠোঁটের মতো ত্বকের উপরিভাগের শিরায় স্থাপন করে লোহিত এবং শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা নির্ধারণ করে।
মাইক্রো-পার্টিকেল প্রযুক্তি
আন্তর্জাতিক বাজারে উপলব্ধ কিছু ডিভাইস মাইক্রো-পার্টিকেল ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তিতে একটি অতি ক্ষুদ্র কণা ত্বকে নিক্ষেপ করে ছোট্ট একটি ছিদ্র তৈরি করে, যার মাধ্যমে নেগেটিভ প্রেশার ব্যবহার করে রক্ত সংগ্রহ করা হয়।
সুচ ছাড়াই হবে রক্ত পরীক্ষার সুবিধাসমূহ
এই আধুনিক প্রযুক্তির অসংখ্য সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, রোগীদের যন্ত্রণা সম্পূর্ণভাবে দূর হয়ে যায়। ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে সূঁচ ফোটানোর সময় যে ব্যথা হয়, তা এই প্রযুক্তিতে নেই। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসা কর্মীদের জন্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়, কারণ সূঁচ থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে না।
শিশুদের জন্য এই প্রযুক্তি বিশেষভাবে উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ শিশু এবং ২৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী সূঁচের ভয়ে ভোগেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের মানসিক চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়।
ঘরে বসে রক্ত পরীক্ষার সুবিধাও এই প্রযুক্তির একটি বড় সুবিধা। রোগীরা নিজেরাই বাড়িতে বসে রক্ত সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে পারেন, যা বিশেষ করে বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক।
বাজার সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ
বিশ্বব্যাপী নিডল-ফ্রি ব্লাড ড্রইং ডিভাইসের বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে এই বাজারের মূল্য ছিল ১৪.৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০৩১ সালের মধ্যে তা ২৬.৫২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৭.৯ শতাংশ।
ভারতীয় বাজারেও এই প্রযুক্তির চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় যেখানে চিকিৎসা সেবা পৌঁছানো কঠিন, সেখানে এই প্রযুক্তি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা প্রদান করতে পারে। সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া এবং আয়ুষ্মান ভারত কর্মসূচির সাথে তাল মিলিয়ে এই প্রযুক্তি দেশের স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব আনতে পারে।
চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতা
যদিও এই প্রযুক্তি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, এই যন্ত্রগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি, যা ব্যাপক ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, সব ধরনের রক্ত পরীক্ষার জন্য এই প্রযুক্তি এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত নয়।
নির্ভরযোগ্যতা এবং নির্ভুলতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যগত পদ্ধতির সাথে তুলনা করে এই নতুন প্রযুক্তির ফলাফল কতটা সঠিক, তা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার ক্ষেত্রে ৯১.৫৯ শতাংশ ফলাফল গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নির্ভুল।
স্বাস্থ্যসেবায় নতুন দিগন্ত
সুচ ছাড়াই হবে রক্ত পরীক্ষা প্রযুক্তি শুধুমাত্র একটি যন্ত্রগত উন্নতি নয়, বরং এটি স্বাস্থ্যসেবায় একটি দর্শনগত পরিবর্তন এনেছে। এই প্রযুক্তি রোগীকেন্দ্রিক চিকিৎসা সেবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষত প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় এর ভূমিকা অপরিসীম।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা যা আগে ভয়ের কারণে অনেকে এড়িয়ে যেতেন, এখন তা সহজ এবং যন্ত্রণাহীন হয়ে উঠেছে। এর ফলে রোগ প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা এবং সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই নতুন অভিযাত্রায় সুচ ছাড়াই হবে রক্ত পরীক্ষা প্রযুক্তি একটি মাইলফলক। ভারতে এর সূচনা হলেও বিশ্বব্যাপী এই প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটছে। আগামী দিনে এই প্রযুক্তি আরো উন্নত এবং সাশ্রয়ী হয়ে উঠলে চিকিৎসাসেবা আরো মানবিক এবং সহজলভ্য হবে। সূঁচের ভয় আর কোনো বাধা থাকবে না নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায়, যা জাতির সার্বিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।