ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বরে এক অবিশ্বাস্য ঘটনায় সরকারি দপ্তরের অভ্যন্তরেই একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিককে কলার ধরে টেনে বের করে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছে। ভুবনেশ্বর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের (বিএমসি) অতিরিক্ত কমিশনার রত্নাকর সাহুর সাথে এই অমানবিক আচরণের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর রাজ্যজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
সোমবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ বিএমসি অফিসে জনগণের অভিযোগ শোনার সময় এই নিন্দনীয় ঘটনা ঘটে। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে রত্নাকর সাহু জানান, বিএমসি কর্পোরেটর জীবন রাউতসহ পাঁচ-ছয়জন তার চেম্বারে ঢুকে পড়েন। তারা অভিযোগ করেন যে তিনি বিজেপি নেতা জগন্নাথ প্রধান ওরফে ‘জগভাই’-এর সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। যখন রত্নাকর এই অভিযোগ মানতে অস্বীকার করেন, তখনই তার সাথে দুর্ব্যবহার ও মারধর শুরু হয়।
ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, কীভাবে সরকারি আধিকারিককে অফিস থেকে কলার ধরে হিড় হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে মাটিতে শুইয়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মুখে একের পর এক লাথি মারা হয়। সাহায্যের জন্য আকুতি জানিয়ে বার বার ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন রত্নাকর, কিন্তু তার আবেদনে কোনো সাড়া না দিয়ে চলতে থাকে নির্মম মারধর।
আক্রমণকারীরা শুধু মারধরেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং রত্নাকরকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। তার জামার কলার টেনে মারধর এবং হেনস্থা করার সময় তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এই ঘটনার পর রত্নাকর সাহু পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে জীবন রাউত, রশ্মি মহাপাত্র এবং দেবাশীষ প্রধান নামে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএমসির মেয়র সুলোচনা দাস ঘটনার তীব্র নিন্দা করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা দায়েরের দাবি করেছেন।
ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পর ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিজু জনতা দলের প্রধান তার এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “নিজের অফিসেই একজন সিনিয়র সরকারি আধিকারিক হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। তাহলে রাজ্যের সাধারণ মানুষের সুরক্ষা কোথায়?” তিনি এই ঘটনায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
পট্টনায়েক আরও বলেছেন, “ভিডিয়ো দেখে আমি হতবাক। অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এক জন ঊর্ধ্বতন কর্তা, বিএমসির অতিরিক্ত কমিশনার রত্নাকর সাহুকে তাঁর অফিস থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একজন বিজেপি কর্পোরেটরের সামনে নির্মমভাবে লাথি মারা হয়।” তিনি এই আক্রমণকে ‘নৃশংস’ তকমা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝিকে হামলার ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন3।
ঘটনার পর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি সোমবারই প্রশাসনিক আধিকারিকদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পুরসভার মধ্যে এমন ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন মেয়র সুলোচনা দাসও।
প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিরোধী বিজু জনতা দল। বিএমসির কর্মীরাও বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন এবং ওড়িশার রাজধানী শহরের ব্যস্ততম জনপথ অবরোধ করে প্রতিবাদ দেখিয়েছেন। বিএমসি কর্তার উপর হামলার প্রতিবাদে ওড়িশা প্রশাসন পরিষেবা সমিতি মঙ্গলবার থেকে ‘গণ ছুটি’ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই ঘটনাটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের প্রশ্নে গুরুতর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। একজন সরকারি আধিকারিক যদি তার নিজের কার্যালয়েই নিরাপদ না থাকেন, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
বিজেপি শাসিত ওড়িশায় এই ঘটনা রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিরোধীরা একযোগে বর্তমান সরকারের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন। পুলিশ যদিও দ্রুত গ্রেফতার করেছে, তবুও এমন সাহসী হামলা প্রশাসনের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সরকারি কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে কোনো সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। এই ঘটনা সেই দায়িত্ব পালনে সরকারের ব্যর্থতাকেই প্রমাণ করে। আশা করা যায়, এই ঘটনার পর প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করবে এবং সকল সরকারি কর্মচারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।