কোন মাসে লাউ খেতে নেই? শুধু বৈজ্ঞানিক কারণ নাকি কুসংস্কার!

স্টাফ রিপোর্টার 6 Min Read

bottle gourd eating restrictions months: আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে রয়েছে হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য ও নিয়মকানুন। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কোন মাসে লাউ খেতে নেই। এই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মনেই কৌতূহল রয়েছে। আজকের এই লেখায় আমরা জানবো কেন নির্দিষ্ট কিছু মাসে লাউ খাওয়া নিষিদ্ধ, এর পেছনে কী ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ খাওয়া কেন নিষিদ্ধ?

বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ খাওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়। এই নিয়মটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বিধান নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে গভীর বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক কারণ।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি

প্রাচীন শাস্ত্র অনুযায়ী, জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ খেলে শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয় এবং সংসারে অমঙ্গলের ছায়া পড়তে পারে। বিশেষ করে যাদের প্রথম সন্তান পুত্র, তাদের জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ খাওয়া একেবারেই উচিত নয় বলে বিশ্বাস করা হয়। এই বিশ্বাস অনুযায়ী, এ সময় লাউ খেলে লক্ষ্মীদেবী রুষ্ট হতে পারেন এবং পুত্রসন্তান রোগাক্রান্ত হতে পারে।

বৈজ্ঞানিক কারণ

আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউয়ের মধ্যে ছোট ছোট পোকা ধরে যা খালি চোখে দেখা যায় না। গরম শেষে বর্ষা এলে এই পোকাগুলো বড় হয়ে ওঠে। এই কারণে পেটে কৃমির মতো রোগ এড়াতে জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এছাড়াও, জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউয়ের মধ্যে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে যায় যা রান্নার পরেও সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয় না।

কৃষিভিত্তিক যুক্তিযুক্ত কারণ

জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ না খাওয়ার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিভিত্তিক কারণও রয়েছে। জ্যৈষ্ঠের পরেই আসে আষাঢ় ও শ্রাবণ, অর্থাৎ গ্রীষ্মের পরে বর্ষাকাল। এই সময়টা নতুন বীজ থেকে চারাগাছ পাওয়ার উপযুক্ত ঋতু।

বীজ সংরক্ষণের জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউগুলো গাছেই রেখে দেওয়া হয়, যাতে পরবর্তী মৌসুমে বীজতলায় বিছিয়ে নতুন গাছের প্রস্তুতি নেওয়া যায়। যেহেতু সব বীজ থেকে গাছ জন্মায় না, তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে লাউ ও তার বীজ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিষিদ্ধ খাবারের তালিকা: সুস্থ থাকার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা

ভাদ্র মাসেও লাউ খাওয়া নিষিদ্ধ

শুধুমাত্র জ্যৈষ্ঠ মাস নয়, ভাদ্র মাসেও লাউ খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শাস্ত্র মতে ভাদ্র মাসে সবুজ সবজি, বিশেষ করে লাউ খেতে নেই কারণ এই মাসে এসব সবজি খেলে শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।

আয়ুর্বেদিক ব্যাখ্যা

আয়ুর্বেদের ‘ঋতুচর্যা’ অনুযায়ী, ভাদ্র মাসে শরীরে পিত্ত প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে যেসব খাবার অতিরিক্ত পিত্তের সম্ভাবনা বাড়ায়, সেগুলো এড়িয়ে চলতে বলা হয়। লাউ এই ধরনের খাবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

বর্ষাকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকি

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, ভাদ্র মাসে বৃষ্টি বেশি হয়। এই সময়ে পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়ে এবং শাক-সবজিতে তাদের উপস্থিতি থাকে বেশি। খুব ভালো করে ধুলেও অনেক সময় নোংরা থেকে যায়। এমন কিছু পোকা থাকে যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না।

লাউয়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা ও ঝুঁকি

লাউ একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি যার ৯৬ শতাংশই পানি। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং নিকোটিনিক অ্যাসিড।

উপকারিতাসমূহ

লাউয়ের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ, হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং গরমের দিনে শরীর ঠান্ডা রাখে। নিয়মিত লাউ খেলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর হয়।

সম্ভাব্য ঝুঁকি

তবে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে লাউ খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। যারা ঠান্ডা, হাঁপানি এবং সাইনোসাইটিসের মতো সমস্যায় ভুগছেন, তাদের লাউ খাওয়ার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। লাউ শীতল প্রকৃতির হওয়ায় এই ধরনের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে তেতো লাউয়ের ব্যাপারে। যদি লাউয়ের রস তেতো হয়, তাহলে তা পান করলে শরীরের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত হতে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

অন্যান্য মাসে সবজি খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন সবজি খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মাঘ মাসে মূলো এবং চৈত্র মাসে শিম খাওয়া নিষিদ্ধ। এছাড়াও বিভিন্ন তিথিতে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে নিষেধ রয়েছে।

চন্দ্রের প্রভাব

শাস্ত্র অনুযায়ী, বিভিন্ন তিথিতে চন্দ্রের আকর্ষণে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রসের তারতম্য ঘটে। সেই রসের সাথে যেসব খাবারের রস মিশলে শরীরের অনিষ্ট হতে পারে, সেই সকল খাবারই ওই তিথিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আধুনিক যুগে এই নিয়মের প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান যুগে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন যে এই পুরনো নিয়মগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক। তবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই নিয়মগুলোর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ।

বৈজ্ঞানিক সত্যতা

আধুনিক বিজ্ঞান এই নিয়মগুলোর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেয়েছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যে ব্যাকটেরিয়া ও পোকামাকড়ের সংক্রমণ বাড়ে। একইভাবে বর্ষাকালে আর্দ্রতা বৃদ্ধির কারণে খাদ্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে সতর্কতা

তবে বর্তমানে উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমে গেছে। তারপরেও সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো, বিশেষ করে যারা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে সবজি কিনে থাকেন তাদের জন্য।

কোন মাসে লাউ খেতে নেই – এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, প্রধানত জ্যৈষ্ঠ ও ভাদ্র মাসে লাউ খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। এই নিয়মের পেছনে রয়েছে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক – তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই নিয়মগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আজও অনেকাংশে প্রাসঙ্গিক। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের অবস্থা ও আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতির কথাও বিবেচনা করা উচিত।

Share This Article