Buddha Purnima 2025 full schedule: বৈশাখ মাসের শেষভাগে আমরা আবারও দেখতে পাব ২০২৫ সালের অন্যতম পবিত্র তিথি বুদ্ধপূর্ণিমা। এই বিশেষ দিনটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং সনাতন ধর্মের মানুষদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১২ মে ২০২৫ তারিখে এই পবিত্র দিনটি পালিত হবে। বুদ্ধপূর্ণিমায় ভগবান গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ এবং মহাপরিনির্বাণ – এই তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা একই তিথিতে সংঘটিত হওয়ায় এই দিনটির মাহাত্ম্য বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আসুন জেনে নেই বুদ্ধপূর্ণিমার তারিখ, তিথি শুরু ও শেষের সময় সহ এই পবিত্র দিনের সাথে জড়িত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
বুদ্ধপূর্ণিমা ২০২৫-এর তারিখ ও সময়সূচি
২০২৫ সালের বুদ্ধপূর্ণিমা ১২ মে সোমবার পালিত হবে। বিভিন্ন পঞ্জিকা অনুসারে পূর্ণিমা তিথির শুরু ও শেষের সময় নিম্নরূপ:
বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে:
পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ: ২৭ বৈশাখ, রবিবার (১১ মে, ২০২৫), রাত ৮টা ২ মিনিট
পূর্ণিমা তিথি শেষ: ২৮ বৈশাখ, সোমবার (১২ মে, ২০২৫), রাত ১০টা ২৬ মিনিট
গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুসারে:
পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ: ২৭ বৈশাখ, রবিবার (১১ মে, ২০২৫), সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিট ৪৯ সেকেন্ড
পূর্ণিমা তিথি শেষ: ২৮ বৈশাখ, সোমবার (১২ মে, ২০২৫), রাত ৯টা ১৮ মিনিট ১৪ সেকেন্ড
অন্যান্য সূত্র অনুসারে, পূর্ণিমা তিথি ১১ মে সন্ধ্যা ৮:০১ মিনিটে শুরু হয়ে ১২ মে রাত ১০:২৫ মিনিটে শেষ হবে। উদয়তিথি অনুসারে ১২ মে সোমবার বুদ্ধপূর্ণিমা পালিত হবে।
ভগবান বুদ্ধের জীবন ও বুদ্ধপূর্ণিমার তাৎপর্য
বুদ্ধপূর্ণিমা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, করুণা এবং অহিংসার পথে চলার অনুপ্রেরণা দেয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিনেই গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন নেপালের লুম্বিনীতে, সিদ্ধার্থ নামে। একই দিনে তিনি বোধগয়ায় এক পিপল (অশ্বত্থ) গাছের নিচে ধ্যান করে আলোকপ্রাপ্ত হন এবং পরবর্তীতে কুশীনগরে এই তিথিতেই মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। এই কারণেই বুদ্ধ পূর্ণিমা শুধুমাত্র তাঁর জন্মদিন নয়, বরং তাঁর জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতীক।
ভগবান গৌতম বুদ্ধ নেপালের লুম্বিনী নগরে রাজা শুদ্ধোদন এবং মায়াদেবীর পুত্র রূপে পৃথিবীতে আসেন। কপিলাবস্তু নগরে তিনি বড় হয়ে ওঠেন। কিন্তু রাজপরিবারের বিলাসিতা, স্ত্রী যশোদা এবং পুত্র রাহুলও গৌতম বুদ্ধকে সংসারের মায়ায় আবদ্ধ করতে পারেননি।
পুরাণ মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ সালে রাজা শুদ্ধধনের পুত্র হিসেবে মা মহামায়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন সিদ্ধার্থ। জগতের দুঃখ ও মায়া বোঝার আকাঙ্ক্ষায় তিনি রাজ্য-পরিবার পরিত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে যাত্রা শুরু করেন। সন্ন্যাসী এবং শবদেহ (শববাহী) দেখে গৌতম বুদ্ধের জীবন সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন হয়। জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুকে জয় করার উদ্দেশে তিনি স্ত্রী, পুত্র, বিলাসিতা, রাজধর্ম, ধনসম্পদ ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক হিসাবে ধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হন।
বুদ্ধপূর্ণিমার বিশেষ অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি
বুদ্ধপূর্ণিমায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই দিনে ভক্তরা ভগবান বুদ্ধের বাণী স্মরণ করে তাঁর আদর্শে চলার সংকল্প গ্রহণ করেন। দেশ-বিদেশের বৌদ্ধ মন্দির, বিহারে বিশেষ পুজো, ধ্যান, ধর্মোপদেশ, ভিক্ষু সম্মেলন এবং দান-ধর্মের কর্মসূচি আয়োজিত হয়। অনেকে গরিব-অসহায় মানুষদের খাদ্য ও বস্ত্র দান করেন।
এই দিনে করণীয় বিশেষ অনুষ্ঠান:
গঙ্গা স্নান: বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন গঙ্গা স্নানের বিশেষ সময় থাকবে ১২ মে ২০২৫ সোমবার সকাল ৬টার পর থেকে রাত্রি ৯টা ১৯ মিনিটের মধ্যে। যদি গঙ্গায় গিয়ে স্নান করা সম্ভব না হয় তাহলে বাড়ির জলে গঙ্গাজল মিশিয়ে স্নান করতে হবে।
সত্যনারায়ণের ব্রত ও পূজা: বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণের ব্রত ও পূজা বিশেষ সময় ১২ মে ২০২৫ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটের পর থেকে সন্ধ্যা ৭টা ৪২ মিনিটের মধ্যে।
অশ্বত্থ গাছের তলায় প্রদীপ জ্বালানো: ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই দিনে অশ্বত্থ (পিপল) গাছের তলায় প্রদীপ জ্বালালে জীবনের সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যায়। ঠিক যেমন ভগবান বুদ্ধ এই গাছের নিচে ধ্যান করে জ্ঞানলাভ করেছিলেন।
দান ধর্ম: এই দিনে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের দান করার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।
ব্রত উপবাস: বুদ্ধ পূর্ণিমার ব্রত উপবাস পালন করা হবে ১২ মে ২০২৫, বাংলা ২৮শে বৈশাখ ১৪৩২, সোমবার।
বুদ্ধপূর্ণিমার বিশেষ যোগ ও তার গুরুত্ব
২০২৫ সালের বুদ্ধপূর্ণিমায় একটি বিরল যোগ তৈরি হচ্ছে। এর সঙ্গে রবি যোগেরও সমন্বয় রয়েছে। শাস্ত্র মতে মনে করা হয় বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে নিষ্ঠা ভরে ব্রত পালন করলে সহজে ঈশ্বরের কৃপা দৃষ্টি পাওয়া সম্ভব হয়। এর ফলে যাবতীয় বাধা ও বিপত্তি দূর হয়। আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব।
এই দিনে ভগবান বিষ্ণুর পূজার তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈশাখ পূর্ণিমায় বিভিন্ন শুভ যোগ তৈরি হয়, যা ভক্তদের জীবনে অনেক সুফল বয়ে আনে। এই যোগগুলিতে ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করে ভক্তরা ভগবানের বিশেষ আশীর্বাদ লাভ করেন এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হয়।
বুদ্ধপূর্ণিমার ইতিহাস ও ধর্মীয় গুরুত্ব
বুদ্ধপূর্ণিমা সনাতন হিন্দু ধর্মেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সনাতন ধর্মে ভগবান বিষ্ণুর নবম অবতার হিসেবে গৌতম বুদ্ধকে মানা হয়। তাই এই দিনটি হিন্দু ধর্মেও পবিত্র। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তিনি জন্মগ্রহণ, বোধিলাভ এবং মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন বলে এই দিনটি ‘ত্রিপিঠক’ নামেও পরিচিত।
২৫৬৯ বছর আগে (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ সালে) জন্মগ্রহণ করে বুদ্ধ তাঁর শিক্ষা ও দর্শন দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করেছেন। অহিংসা, করুণা, সত্য অনুসন্ধান ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের তাঁর শিক্ষা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বুদ্ধ পূর্ণিমাতে ২০২৫ সালে বুদ্ধাব্দ ২৫৭০ বর্ষ আরম্ভ হবে।
গোস্বামী মতে এই তিথিটি মাধুরী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত, যা শ্রীকৃষ্ণের ফুলদোল উৎসবের সাথে সম্পর্কিত। এভাবেই একই তিথি বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে বিভিন্ন নামে ও রূপে গুরুত্ব পেয়ে আসছে।
২০২৫ সালের বুদ্ধপূর্ণিমার বিশেষ মুহূর্ত
বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ২০২৫ সালের বুদ্ধপূর্ণিমার জন্য বিশেষ সময়সূচি নিম্নরূপ:
বুদ্ধ পূর্ণিমার নিশি পালন: ১১ মে ২০২৫, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩২, রবিবার
ব্রত উপবাস পালন: ১২ মে ২০২৫, ২৮শে বৈশাখ ১৪৩২, সোমবার
শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণের ব্রত ও পূজা: ১২ মে ২০২৫, সোমবার সন্ধ্যা ৬:০৬ থেকে ৭:৪২ মিনিটের মধ্যে
গঙ্গা স্নানের বিশেষ সময়: ১২ মে ২০২৫, সোমবার সকাল ৬টা থেকে রাত্রি ৯:১৯ মিনিটের মধ্যে
শ্রীশ্রী গন্ধেশ্বরী পূজা: ১২ মে ২০২৫, সোমবার রাত্রি ৯:১৯ মিনিটের মধ্যে
বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে সুফল প্রাপ্তির উপায়
বুদ্ধপূর্ণিমার এই তিথিতে বিশেষ কিছু নিয়ম পালনের মাধ্যমে সকল বাধা ও বিপত্তি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। নিম্নলিখিত উপায়গুলি অনুসরণ করে আপনি বুদ্ধপূর্ণিমার পূর্ণ সুফল পেতে পারেন:
ভোরে স্নান: বুদ্ধপূর্ণিমার দিন ভোরবেলায় উঠে স্নান করা শুভ। বিশেষ করে গঙ্গা স্নান করার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।
দান ধর্ম: এই দিনে দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে খাদ্য, বস্ত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দান করা উচিত।
অশ্বত্থ গাছে জল দান ও প্রদীপ জ্বালানো: অশ্বত্থ (পিপল) গাছে জল দিয়ে তার তলায় প্রদীপ জ্বালালে সর্বপ্রকার দুঃখ দূর হয়।
ধ্যান ও প্রার্থনা: বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে ধ্যান করা এবং বুদ্ধের বাণী স্মরণ করার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা যায়।
বুদ্ধের শিক্ষা অনুসরণ: এই দিনে বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনে সেগুলি অনুসরণ করার সংকল্প নেওয়া উচিত।
বুদ্ধপূর্ণিমা একটি মহামূল্যবান দিন, যা শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য স্মরণীয়। ২০২৫ সালের বুদ্ধপূর্ণিমা, ১২ মে সোমবার, অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে পালন করার মাধ্যমে আমরা ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদ লাভ করতে পারি। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের জীবনকে আলোকিত করুক এবং সমাজে শান্তি ও সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করুক – এই কামনাই করি বুদ্ধপূর্ণিমার এই পবিত্র দিনে।
বুদ্ধের বাণী “সদা সত্যেতে মন রাখো, নিজ পথে চলো, কৃতকর্মে ভয় পেও না, একমাত্র একা হলেও সৎ পথে চলো” – এই বার্তা আমাদের জীবনের অন্ধকার দূর করে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাক। বুদ্ধপূর্ণিমার এই পবিত্র দিনে আমরা সকলে বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করে তুলি।