বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রা: সাধারণ মানুষের মতোই বিদায়।

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গত ৮ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে কলকাতার পাম অ্যাভিনিউতে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর পরিবারের ইচ্ছানুসারে, তিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদা নয়, বরং একজন সাধারণ…

Chanchal Sen

 

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গত ৮ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে কলকাতার পাম অ্যাভিনিউতে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর পরিবারের ইচ্ছানুসারে, তিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদা নয়, বরং একজন সাধারণ রাজ্যবাসীর মতোই শেষ যাত্রা করেছেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে তাঁর শেষকৃত্যে গান স্যালুট দেওয়া হয়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। ২০২১ সালের মে মাসে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছিল। তিনি সকাল ৮:২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, যখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

শেষ যাত্রার বিবরণ

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর, তাঁর দেহ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম জানান, “আজ আমরা তাঁর দেহ সংরক্ষণ করব। বৌদির সঙ্গে কথা হয়েছে, দলের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমাদের পার্টির সিদ্ধান্ত।” সকাল থেকেই পার্ক সার্কাসের ‘পিস ওয়ার্ল্ড’-এ বুদ্ধদেবের অনুরাগীদের ভিড় বাড়তে থাকে। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তাঁর দেহ সংরক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। প্রিয় নেতাকে শেষবার দেখতে ও শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকে অগণিত মানুষ বুদ্ধবাবুর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে ভিড় করেন। এটি প্রমাণ করে যে তিনি জনগণের কাছে কতটা প্রিয় ছিলেন।

বুদ্ধ বাবুর চোখ দিয়ে এবার মায়ের আগমনী দেখবে আরো দুজন

সরকারি মর্যাদা প্রত্যাখ্যান

যদিও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর পরিবার সরকারি মর্যাদায় শেষকৃত্য করতে অস্বীকার করেছে। তাঁরা চেয়েছেন যে তিনি একজন সাধারণ নাগরিকের মতোই শেষ যাত্রা করুন। এটি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাদামাটা জীবনযাপনের প্রতিফলন, যা তিনি সারা জীবন ধরে বজায় রেখেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন যে রাজ্য সরকার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে গান স্যালুট দেবে। কিন্তু পরিবারের অনুরোধে এটি করা হয়নি

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবন ও কর্মজীবন

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র।১৯৬৬ সালে তিনি সিপিএম দলে প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। তিনি নিয়মিতভাবে খাদ্য আন্দোলন-সহ দলের নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি দলের যুব শাখা ডেমোক্রেটিক ইউথ ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক ছিলেন।

১৯৭৭ সালে কাশীপুর-বেলগাছিয়া বিধানসভা আসন থেকে প্রথম বিধায়ক হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। প্রথমবার বিধানসভায় জিতেই তিনি মন্ত্রী হন। তথ্য ও জনসংযোগ দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।২০০০ সালের ৬ নভেম্বর তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাজ্যের সপ্তম মুখ্যমন্ত্রী। ২০০০-২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর তিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

“আমরা বুদ্ধবাবুর যোগ্য নই”, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে শোকাহত বাংলার শিল্পী সমাজ

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক অবদান

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ব্যবসা সংক্রান্ত তার অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত নীতির জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের চেষ্টা করেছিলেন, যদিও এটি বিতর্কিত হয়েছিল।তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তার মেয়াদে শক্তিশালী জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদ এবং প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগের মুখোমুখি হন। এর ফলে তিনি ২০১১ সালের নির্বাচনে হেরে যান। যার ফলে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের পতন ঘটে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকার ছিল।

ব্যক্তিগত জীবন

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মীরা ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেছিলেন। সুচেতনা ভট্টাচার্য নামে তাদের একটি মেয়ে রয়েছে। পরিবারটি কলকাতার বালিগঞ্জে বসবাস করত। তিনি কয়েক দশক ধরে দুই কক্ষের বাসায় ছিলেন এবং একই বাসভবন থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার মিতব্যয়ী জীবনধারার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি যদিও পুরোহিতদের পরিবারের অন্তর্গত ছিলেন, তবুও কমিউনিজমের নীতি অনুসারে একজন স্বীকৃত নাস্তিক ছিলেন।

শোক প্রকাশ

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে পূর্ণদিবস সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু শোকস্তব্ধ হয়ে বলেন, “আমি শুনেছি ভীষণ ভীষণ ক্রিটিক্যাল। আমি তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছি, তখনই ফোন আসে। দীর্ঘদিন মানুষের স্বার্থে কাজ করেছেন। ক্ষতি হয়ে গেল। বন্ধু চলে গেলে ক্ষতি হয় না!”

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওঁ ভীষণ সিগারেট খেতেন। সেটা আমি লক্ষ্য করেছি। এত সিগারেট খাওয়াটা আমার খুব একটা পছন্দ হত না। আমি দেখেছিলাম, হাতটা একটু কাঁপচ্ছে। ইচ্ছা ছিল বলি, যে এত সিগারেট খাবেন না, কিন্তু সেটা বলতে সাহস পায়নি। তারপর দেখলাম সিওপিডি-তে ভুগছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। আপাদমস্তক একজন বাঙালি ভদ্রলোক। অত্যন্ত সৎ মানুষ।”

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি যুগের অবসান ঘটাল। তাঁর সাদামাটা জীবনযাপন এবং সততা অনেকের কাছে অনুকরণীয় ছিল। তাঁর মৃত্যুতে বামপন্থী রাজনীতি একজন প্রভাবশালী নেতাকে হারাল।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।