পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ছেলেমেয়েরা পাস করে কোথায় যাবে, বড় মাপের ইন্ডাস্ট্রি করতে হবে”। এই উক্তিটি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ১৯৭৭ সালে প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হন এবং দীর্ঘদিন জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ২০০০ সালে জ্যোতি বসুর অবসরের পর তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং ২০১১ সাল পর্যন্ত সেই পদে থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বুদ্ধদেব রাজ্যে শিল্পস্থাপনে উদ্যোগী হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজ্যে শিল্প আনতে গেলে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের থেকে দূরত্ব রাখা যাবে না। এই ধারণাটি তিনি বামফ্রন্টের অন্দরেও ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর বুদ্ধদেব সরকার বেশ কিছু বড় শিল্প প্রকল্পের ঘোষণা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
এছাড়াও, কলকাতার উপকণ্ঠে তথ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র গড়ার লক্ষ্যে প্রথম সারির অনেক তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন বুদ্ধদেব সরকার।
কিন্তু এই উদ্যোগগুলি বাস্তবায়নে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্প নিয়ে উদ্যোগী হলেও তা বাস্তবায়নে বেশ কিছু ভুল ছিল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। জমি সংক্রান্ত আন্দোলন থেকেই বামফ্রন্টের শক্তি দুর্বল হতে থাকে এবং ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৩৪ বছরের বাম সরকারের অবসান হয়। বুদ্ধদেব সরকারের পতনের পর থেকেই রাজ্যে নতুন শিল্প তৈরির যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে ধাক্কা খায়। একে একে বিভিন্ন শিল্প তৈরির গতি স্তব্ধ হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে শিল্প ও কাজের সুযোগ অনেক কম।
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পায়নের স্বপ্নের পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন, বড় মাপের উৎপাদন শিল্প না থাকলে ছোট ও মাঝারি কলকারখানার দমবন্ধ হয়ে আসে। তিনি হাওড়া ও বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দৃষ্টান্ত দিয়ে এই যুক্তি তুলে ধরেছিলেন।
বুদ্ধদেবের এই দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার আলোকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি ও মাঝারি আকারের শিল্পের উপর নির্ভরশীল, যদিও রাজ্যটির অর্থনীতিতে সেবা এবং ভারী শিল্পগুলির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।১৯৮০ এর দশকের পর থেকে খাদ্য উৎপাদনে রাজ্যটির একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং রাজ্যটি এখন কয়েকটি ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে একটি যে সমস্ত রাজ্য খাদ্য উৎপাদনের একটি উদ্বৃত্ত অংশ রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ভারতবর্ষে জনসংখ্যার মাত্র ১৫% অংশ হয়েও রাজ্যটি ভারতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎপাদক রাজ্যগুলির একটি, দেশের চালের প্রায় ২০% এবং আলুর উৎপাদনের ৩৩% উৎপাদন করে। তবে, শিল্পায়নের ক্ষেত্রে রাজ্যটি এখনও পিছিয়ে রয়েছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্বেগ ছিল যে শিক্ষিত যুবকদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে। তিনি মনে করতেন, বড় মাপের শিল্প স্থাপন করা না গেলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। বুদ্ধদেবের এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্যোগের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী। যদিও তাঁর সরকারের সময় অনেক বড় শিল্প প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু তিনি রাজ্যে শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু করেছিলেন। এই আলোচনা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ পশ্চিমবঙ্গ এখনও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক জীবন এবং শিল্পায়নের প্রচেষ্টা থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেতে পারি:
সামগ্রিকভাবে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পায়নের স্বপ্ন এবং তার বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যদিও তাঁর প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হয়নি, কিন্তু তিনি যে আলোচনা শুরু করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক এবং রাজ্যের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্য করুন