CAA বাস্তবায়নের ঘোষণা: নাগরিকত্ব আইনে কী পরিবর্তন আসছে?

ভারত সরকার সোমবার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বাস্তবায়নের ঘোষণা করেছে। ২০১৯ সালে পাস হওয়া এই আইনটি এতদিন কার্যকর করা হয়নি। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।…

Ishita Ganguly

 

ভারত সরকার সোমবার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) বাস্তবায়নের ঘোষণা করেছে। ২০১৯ সালে পাস হওয়া এই আইনটি এতদিন কার্যকর করা হয়নি। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

CAA কী?

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) হল ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের একটি সংশোধনী। এর মূল উদ্দেশ্য হল আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান শরণার্থীদের দ্রুত ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা।প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি:

  • ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর আগে ভারতে প্রবেশ করা উল্লিখিত ৬টি ধর্মের শরণার্থীরা এই আইনের আওতায় পড়বেন।
  • নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বসবাসের সময়সীমা ১১ বছর থেকে কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে।
  • এই আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব পাওয়া ব্যক্তিদের ভারতে প্রবেশের তারিখ থেকেই নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে।

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, CAA-এর আওতায় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে একটি অনলাইন পোর্টাল চালু করা হয়েছে। যোগ্য ব্যক্তিরা এই পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন। সরকার স্পষ্ট করেছে যে CAA-এর আওতায় নাগরিকত্বের জন্য নিম্নলিখিত নথিগুলি প্রয়োজন হবে:

  • জন্মস্থান প্রমাণের জন্য নথি
  • বাংলাদেশ/পাকিস্তান/আফগানিস্তানে বসবাসের প্রমাণপত্র
  • ভারতে প্রবেশের তারিখ
  • ভারতে অবস্থানের প্রমাণপত্র

প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক

CAA বাস্তবায়নের ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন অংশে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভ দেখা গেছে। আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করেছে যে নির্বাচনের আগে ভোট পোলারাইজ করার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেছেন, “নয়টি সময়সীমা বাড়ানোর পর এখন নির্বাচনের ঠিক আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যা স্পষ্টতই পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ভোট মেরুকরণের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে”।

সমালোচনা

CAA-কে নিয়ে প্রধান সমালোচনাগুলি:

  1. মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য: সমালোচকরা মনে করেন, এই আইন মুসলিমদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া ধর্মনিরপেক্ষতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী।
  2. অন্যান্য নির্যাতিত গোষ্ঠীর বাদ পড়া: পাকিস্তানের শিয়া, বেলুচি ও আহমদিয়া মুসলমান এবং আফগানিস্তানের হাজারাদের মতো নির্যাতিত গোষ্ঠীরা এই আইনের আওতায় পড়েননি।
  3. উত্তর-পূর্ব ভারতের উদ্বেগ: অসম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরার উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে এই আইন প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু এসব রাজ্যে অনেকে মনে করেন এই আইন তাদের জনসংখ্যার ভারসাম্য ও সংস্কৃতিকে হুমকির মুখে ফেলবে।
  4. NRC-এর সাথে সম্পর্ক: অনেকে আশঙ্কা করছেন CAA-কে ভবিষ্যতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হতে পারে, যা মুসলিমদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

সম্ভাব্য প্রভাব

CAA বাস্তবায়নের ফলে নিম্নলিখিত প্রভাবগুলি দেখা যেতে পারে:

  1. দ্রুত নাগরিকত্ব: উল্লিখিত ৬টি ধর্মের শরণার্থীরা অপেক্ষাকৃত সহজে ও দ্রুত ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে পারবেন।
  2. রাজনৈতিক মেরুকরণ: নির্বাচনের আগে এই আইন বাস্তবায়ন করায় ভোটারদের মধ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভাজন তৈরি হতে পারে।
  3. আন্তর্জাতিক সমালোচনা: ২০১৯ সালের মতো এবারও আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
  4. আইনি চ্যালেঞ্জ: বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
  5. প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ক: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে জটিলতা দেখা দিতে পারে।

CAA বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। একদিকে যেমন কিছু শরণার্থী গোষ্ঠী উপকৃত হবে, অন্যদিকে এটি ধর্মীয় বিভাজন ও সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। সরকারের পক্ষে চ্যালেঞ্জ হবে কীভাবে এই আইন ন্যায়সঙ্গত ও সমতাভিত্তিক উপায়ে বাস্তবায়ন করা যায়। আগামী দিনগুলিতে এই ইস্যুটি নিয়ে আরও বিতর্ক ও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।