সরকারি বা বেসরকারি চাকরি, ‘ক্যাজুয়াল লিভ’ (Casual Leave) বা CL হলো কর্মীদের সবচেয়ে প্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত ছুটির অস্ত্র। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই ছুটির নিয়মে এমন কিছু সূক্ষ্ম শর্ত বা ‘ফাঁদ’ রয়েছে যা না জানলে আপনার ছুটির আবেদন শুধু বাতিলই হবে না, বরং আপনার বেতন কাটার বা ‘সার্ভিস ব্রেক’ (Service Break)-এর ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে? বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম বা West Bengal Service Rules (WBSR) অত্যন্ত কড়া। টানা ৭ দিনের বেশি CL নিলে কী হয়? বা ছুটির মাঝখানের শনি-রবিবার কি আপনার ছুটির ব্যালেন্স থেকে কাটা যাবে? আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা ক্যাজুয়াল লিভ বা CL সম্পর্কিত সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ম, শর্ত এবং ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ক্যাজুয়াল লিভ (CL) আসলে কী?
ক্যাজুয়াল লিভ বা নৈমিত্তিক ছুটি হলো এমন এক ধরণের ছুটি যা একজন কর্মী আকস্মিক কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজন, অসুস্থতা বা জরুরি কাজে নিতে পারেন। টেকনিক্যালি, CL-এ থাকাকালীন একজন কর্মীকে ‘অন ডিউটি’ (On Duty) হিসেবেই গণ্য করা হয়। অর্থাৎ, তিনি ছুটিতে থেকেও খাতায়-কলমে কর্মরত। এই কারণেই CL চলাকালীন কোনো কর্মী বেতন বা অ্যালাউন্স থেকে বঞ্চিত হন না।
তবে মনে রাখবেন, এই ছুটি অধিকার হিসেবে দাবি করা যায় না। এটি সম্পূর্ণভাবে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের (Sanctioning Authority) ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীদের ২০২৫ সালের ছুটি: কমল বেশ কয়েকটি ছুটি
প্রধান নিয়মাবলী: এক নজরে (Key Rules)
পশ্চিমবঙ্গ সার্ভিস রুলস (Part-I, Appendix 10) অনুযায়ী রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য CL-এর নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। নিচে প্রধান নিয়মগুলো উল্লেখ করা হলো:
| বিষয় | নিয়ম (Rules) |
| বাৎসরিক কোটা | ১ বছরে সর্বোচ্চ ১৪ দিন (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর)। |
| টানা ছুটির সীমা | একবারে টানা ৭ দিনের বেশি নেওয়া যাবে না (ছুটি ও শনি-রবিবার মিলিয়ে)। |
| জমিয়ে রাখা | এই ছুটি পরের বছরের জন্য জমিয়ে রাখা বা Carry Forward করা যায় না। |
| নগদায়ন (Encashment) | CL বিক্রি বা নগদায়ন করা যায় না। |
| অর্ধ-দিবস ছুটি | হাফ-ডে বা অর্ধ-দিবস CL নেওয়া সম্ভব। |
গুরুত্বপূর্ণ নোট: নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়া কর্মীদের ক্ষেত্রে, প্রথম বছরে যত মাস চাকরি বাকি আছে, সেই অনুপাতে (Pro-rata basis) CL বরাদ্দ করা হয়।
টানা কতদিন CL নেওয়া যায়? (সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি)
বেশিরভাগ কর্মীই এই জায়গায় ভুল করেন। নিয়মে বলা আছে, “CL can not be sanctioned for more than 7 consecutive days at a time including Sundays, holidays and weekly off days.”
এর অর্থ হলো, আপনি যদি CL-এর আবেদন করেন, তবে আপনার মোট অনুপস্থিতি (Total Absence) টানা ৭ দিনের বেশি হতে পারবে না। এখানে শনি, রবি বা অন্য সরকারি ছুটিও গোনা হবে।
উদাহরণ:
ধরুন, আপনি বুধবার থেকে শুক্রবার (৩ দিন) CL নিলেন। এরপর শনি ও রবিবার অফিস ছুটি। সোমবার আবার অফিস। এক্ষেত্রে আপনার মোট অনুপস্থিতি হলো ৫ দিন। এটি গ্রাহ্য।
কিন্তু, আপনি যদি এমনভাবে আবেদন করেন যে মাঝখানে বা আগে-পরে মিলিয়ে মোট অনুপস্থিতি ৭ দিন অতিক্রম করে যায় (যেমন—পুজোর ছুটির সাথে জুড়ে), তবে সেটি আর CL হিসেবে গণ্য হবে না। তখন আপনাকে Earned Leave (EL) বা অন্য ছুটি নিতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাইলে এটি শিথিল করতে পারেন, তবে তা বিরল।
প্রাথমিক শিক্ষকদের Medical Leave নিয়মাবলী: সম্পূর্ণ গাইডলাইন
স্যান্ডউইচ রুল: মাঝখানের ছুটি কি কাটা যায়? (Intervening Holidays)
CL-এর ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হলো ‘স্যান্ডউইচ রুল’-এর অভাব। আর্নড লিভ (EL)-এর ক্ষেত্রে যেমন দুই ছুটির মাঝখানের শনি-রবিবারও ছুটির ব্যালেন্স থেকে কেটে নেওয়া হয়, CL-এর ক্ষেত্রে তা হয় না।
-
নিয়ম: যদি আপনি শুক্রবার CL নেন এবং পরবর্তী সোমবার আবার CL নেন, তবে মাঝখানের শনি ও রবিবার আপনার CL অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা যাবে না। আপনার মাত্র ২ দিন CL খরচ হবে।
-
শর্ত: যদিও মাত্র ২ দিন খরচ হচ্ছে, কিন্তু আপনার ‘টানা অনুপস্থিতি’ (Continuous Absence) ৪ দিন হিসেবে গণ্য হবে। এই মোট অনুপস্থিতি যেন ৭ দিনের বেশি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কার সাথে CL জোড়া যায়, আর কার সাথে যায় না? (Combination of Leave)
CL বা ক্যাজুয়াল লিভ একটি ‘একা’ বা বিচ্ছিন্ন ছুটি। একে অন্য কোনো প্রধান ছুটির সাথে মেশানো যায় না।
যা করা যাবে না:
-
CL-এর সাথে Earned Leave (EL) বা অর্জিত ছুটি জোড়া যাবে না।
-
CL-এর সাথে Half Pay Leave (HPL) বা Commuted Leave জোড়া যাবে না।
-
CL-এর সাথে Maternity Leave বা Child Care Leave (CCL) জোড়া যাবে না।
যা করা যাবে (শর্তসাপেক্ষে):
-
CL-এর সাথে Special Casual Leave (SCL) জোড়া যেতে পারে (যেমন খেলাধুলো বা ট্রেকিং-এর জন্য)।
-
অর্ধ-দিবস বা Half-day CL-এর সাথে পূর্ণ দিবস CL জোড়া যায়।
-
রবিবার বা সরকারি ছুটির (Holidays) আগে (Prefix) বা পরে (Suffix) CL নেওয়া যায়।
লেট এটেন্ডেন্স ও CL-এর সম্পর্ক (Late Attendance Rule)
অফিসে দেরিতে আসার সাথেও CL-এর একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী:
-
প্রতি মাসে ৩ দিন দেরিতে অফিসে এলে (Late Attendance), কর্মীর অ্যাকাউন্ট থেকে ১ দিন CL কেটে নেওয়া হয়।
-
যদি কর্মীর অ্যাকাউন্টে কোনো CL অবশিষ্ট না থাকে, তবে সেক্ষেত্রে Earned Leave (EL) কাটা হবে।
-
EL-ও না থাকলে সেটি ‘Without Pay’ বা বেতনহীন দিন হিসেবে গণ্য হতে পারে।
ক্যাজুয়াল লিভ ও এলটিসি (LTC with CL)
অনেক কর্মীই ভ্রমণের জন্য ‘লিভ ট্রাভেল কনসেশন’ (LTC) নিয়ে থাকেন। মনে রাখবেন, LTC-এর সময়ও CL নেওয়া যায়। অর্থাৎ, আপনি যদি কোথাও ঘুরতে যান এবং LTC দাবি করেন, তবে সেই সময় আপনি CL ব্যবহার করতে পারেন। তবে, এই সময় আপনি কোনো ‘ডেইলি অ্যালাউন্স’ (Daily Allowance) পাবেন না, কারণ আপনি ব্যক্তিগত ভ্রমণে আছেন।
তুলনা: ক্যাজুয়াল লিভ (CL) বনাম আর্নড লিভ (EL)
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুবিধার্থে নিচে একটি তুলনামূলক তালিকা দেওয়া হলো:
| বৈশিষ্ট্য | ক্যাজুয়াল লিভ (CL) | আর্নড লিভ (EL) |
| পরিমাণ (বাৎসরিক) | ১৪ দিন | ৩০ দিন |
| জমানো যায়? | না (বছর শেষে ল্যাপস হয়) | হ্যাঁ (৩০০ দিন পর্যন্ত জমানো যায়) |
| নগদায়ন | সম্ভব নয় | অবসর বা চাকরিকালে সম্ভব (শর্তসাপেক্ষে) |
| ছুটির মাঝখানের দিন | কাটা যায় না (ব্যালেন্স থেকে) | কাটা যায় (ব্যালেন্স থেকে) |
| সর্বোচ্চ সীমা (একবারে) | ৭ দিন (টানা অনুপস্থিতি) | কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই (৩০ দিনের বেশিও হতে পারে) |
| বেতন | পূর্ণ বেতন (On Duty) | পূর্ণ বেতন |
আবেদন বাতিল হওয়ার কারণ ও সতর্কতা
নিম্নলিখিত কারণে আপনার CL-এর আবেদন বাতিল হতে পারে বা সমস্যা তৈরি হতে পারে:
-
৭ দিনের নিয়ম ভঙ্গ: যদি আপনার আবেদন বা অনুপস্থিতি শনি-রবিবার ও ছুটি মিলিয়ে টানা ৭ দিনের বেশি হয়ে যায়।
-
অন্য ছুটির সাথে মিশিয়ে ফেলা: যদি আপনি EL-এর ঠিক আগে বা পরে CL নেওয়ার চেষ্টা করেন।
-
জনস্বার্থে: যদি আপনার অনুপস্থিতিতে দপ্তরের জরুরি কাজ আটকে যায়, তবে কর্তৃপক্ষ বা ‘Leave Sanctioning Authority’ জনস্বার্থে (Public Interest) আপনার ছুটি বাতিল করতে পারেন।
-
দেরিতে আবেদন: যদিও CL আকস্মিক কারণে নেওয়া হয়, তবে পূর্ব-পরিকল্পিত ছুটির ক্ষেত্রে আগেভাগে আবেদন না করলে তা নামঞ্জুর হতে পারে।
ক্যাজুয়াল লিভ বা CL একজন কর্মীর জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক একটি ব্যবস্থা, যা বিপদে-আপদে বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অক্সিজেনের মতো কাজ করে। কিন্তু ‘মঞ্জুর করা বা না করা’ যেহেতু কর্তৃপক্ষের হাতে এবং এর সাথে ‘৭ দিনের টানা অনুপস্থিতি’-র কড়া নিয়ম জড়িয়ে আছে, তাই এই ছুটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। নিয়ম মেনে ছুটি উপভোগ করুন, যাতে বছর শেষে আপনার সার্ভিস বুক (Service Book) পরিষ্কার থাকে এবং কোনো আইনি জটিলতা না পোহাতে হয়।
