বিড়ালের কামড় বা আঁচড়কে অনেকেই সাধারণ ঘটনা বলে মনে করেন, কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক রোগ জলাতঙ্কের (Rabies) ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, জলাতঙ্ক একবার লক্ষণ প্রকাশ পেলে তা ১০০% প্রাণঘাতী, কিন্তু সময়মতো সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ ১০০% প্রতিরোধযোগ্য। তাই বিড়াল কামড়ানোর পর যত দ্রুত সম্ভব, বিশেষ করে কামড়ের দিনই (Day 0) প্রথম টিকা নেওয়া উচিত। চিকিৎসার ভাষায় একে পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফিল্যাক্সিস (Post-Exposure Prophylaxis – PEP) বলা হয়, যা জলাতঙ্কের মতো মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করে। অবহেলা করলে সামান্য একটি আঁচড়ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
বিড়ালের কামড় কেন বিপজ্জনক?
বিড়ালকে সাধারণত শান্ত প্রাণী মনে করা হলেও, ভয় পেলে বা বিরক্ত হলে তারা কামড়াতে বা আঁচড়াতে পারে। পোষা বা রাস্তার বিড়াল, উভয়ের মাধ্যমেই রোগ ছড়াতে পারে। বিড়ালের কামড়ের প্রধান দুটি ঝুঁকি হলো:
১. জলাতঙ্ক (Rabies): এটি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ যা সংক্রামিত প্রাণীর লালার মাধ্যমে ছড়ায়। ভাইরাসটি স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে গেলে এর কোনো চিকিৎসা নেই। বিড়াল, কুকুর, বাদুড়, এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে।
২. ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ: বিড়ালের মুখে Pasteurella multocida নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এর ফলে ক্ষতস্থান ফুলে যাওয়া, লাল হওয়া, প্রচণ্ড ব্যথা এবং সেলুলাইটিসের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে প্রতি বছর জলাতঙ্কে প্রায় ২০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়, যা সারা বিশ্বের মোট জলাতঙ্কজনিত মৃত্যুর ৩৬%। ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (NCDC)-এর মতে, জলাতঙ্কের বেশিরভাগ ঘটনাই কুকুরের কামড়ে হলেও, বিড়ালের কামড়ের ঘটনাও উপেক্ষা করার মতো নয়।
বিড়াল কামড়ালে কত দিনের মধ্যে টিকা দিতে হয়?
বিড়াল কামড়ালে বা আঁচড়ালে এক মুহূর্তও দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। টিকা দেওয়ার সময়সীমা ক্ষত এবং ঝুঁকির ধরনের উপর নির্ভর করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছে।
ক্ষতের শ্রেণীবিভাগ এবং করণীয়
চিকিৎসকরা সাধারণত ক্ষতকে তিনটি ভাগে ভাগ করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করেন।
ক্ষতের শ্রেণী (Category) | ক্ষতের বিবরণ | করণীয় |
প্রথম শ্রেণী (Category I) | অক্ষত চামড়ায় বিড়ালের স্পর্শ বা চাটা। | শুধুমাত্র ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা যথেষ্ট। টিকার প্রয়োজন নেই। |
দ্বিতীয় শ্রেণী (Category II) | চামড়ায় সামান্য আঁচড় বা রক্তপাতহীন কামড়। | ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার পর অবশ্যই জলাতঙ্কের টিকা (Anti-Rabies Vaccine – ARV) নিতে হবে। |
তৃতীয় শ্রেণী (Category III) | এক বা একাধিক গভীর কামড় বা আঁচড়, যার ফলে রক্তপাত হয়েছে। ছেঁড়া চামড়ায় বা শ্লেষ্মা ঝিল্লিতে (mucous membrane) লালা লাগা। | ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার পর জলাতঙ্কের টিকার (ARV) সাথে রেবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন (Rabies Immunoglobulin – RIG) ইনজেকশনও নিতে হবে। |
মূল কথা হলো, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর ক্ষতের ক্ষেত্রে কামড়ের দিনকেই “শূন্য দিন” (Day 0) ধরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকার প্রথম ডোজ নিতে হবে। কোনোভাবেই ২৪ ঘণ্টার বেশি দেরি করা উচিত নয়।
টিকা দেওয়ার সম্পূর্ণ সময়সূচী
জলাতঙ্কের টিকার একটি নির্দিষ্ট সময়সূচী রয়েছে, যা সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত ৫টি ডোজ দেওয়া হয়।
- প্রথম ডোজ: কামড়ের দিন (Day 0)
- দ্বিতীয় ডোজ: কামড়ের ৩ দিন পর (Day 3)
- তৃতীয় ডোজ: কামড়ের ৭ দিন পর (Day 7)
- চতুর্থ ডোজ: কামড়ের ১৪ দিন পর (Day 14)
- পঞ্চম ডোজ: কামড়ের ২৮ দিন পর (Day 28)
কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইন্ট্রাডার্মাল রুটে (চামড়ার মধ্যে) টিকা দিলে সময়সূচীর পরিবর্তন হতে পারে, যা চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন। কোনো ডোজ বাদ দেওয়া উচিত নয়, কারণ এটি টিকার কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।
কামড়ের পর তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা
চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে বাড়িতেই কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করুন:
১. ক্ষতস্থান পরিষ্কার করুন: কামড়ের স্থানটি সাবান এবং প্রবহমান জল দিয়ে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধরে ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। এটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমাতে সাহায্য করে।
২. অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করুন: পরিষ্কার করার পর ক্ষতস্থানে পভিডোন-আয়োডিন বা অন্য কোনো অ্যান্টিসেপটিক লোশন লাগান।
৩. ক্ষতস্থান ঢাকবেন না: ক্ষতস্থানে কোনো সেলাই (stitch) বা ব্যান্ডেজ না করাই ভালো। যদি ব্যান্ডেজ করতেই হয়, তবে হালকা করে করুন যাতে ভেতরে বাতাস চলাচল করতে পারে।
৪. দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান: প্রাথমিক চিকিৎসার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
পোষা বিড়াল কামড়ালে কী করণীয়?
অনেকের ধারণা, নিজের পোষা বিড়াল কামড়ালে টিকার প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে যদি বিড়ালটিকে টিকা দেওয়া থাকে। এটি একটি মারাত্মক ভুল ধারণা।
- টিকা দেওয়া থাকলেও ঝুঁকি থাকে: আপনার পোষা বিড়ালের জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া থাকলেও তার কার্যকারিতা ১০০% নাও হতে পারে বা টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই ঝুঁকি না নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- বিড়ালকে পর্যবেক্ষণ করুন: পোষা বিড়াল কামড়ালে তাকে ১০ দিন চোখে চোখে রাখুন। এই সময়ের মধ্যে যদি বিড়ালটির আচরণে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন (যেমন- অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হওয়া, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করা, মুখ দিয়ে লালা ঝরা) দেখা যায় বা সে মারা যায়, তবে দ্রুত চিকিৎসককে জানান।
- অপেক্ষা করবেন না: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিড়ালকে পর্যবেক্ষণের জন্য ১০ দিন অপেক্ষা করে টিকা নেওয়া শুরু করতে দেরি করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কামড়ের দিনই টিকা নেওয়া শুরু করুন। যদি ১০ দিন পর বিড়ালটি সুস্থ থাকে, তবে চিকিৎসক পরবর্তী ডোজগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
জলাতঙ্ক সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা ও বাস্তবতা
জলাতঙ্ক নিয়ে সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যা সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে বাধা সৃষ্টি করে।
ভুল ধারণা (Myth) | বাস্তবতা (Fact) |
শুধু কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক হয়। | বিড়াল, বাদুড়, বাঁদর, শেয়ালসহ যেকোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী জলাতঙ্কের ভাইরাস বহন করতে পারে। |
ক্ষতস্থানে লঙ্কা বা হলুদের গুঁড়ো লাগালে ভাইরাস মরে যায়। | এটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। এর ফলে ক্ষতস্থানে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। সঠিক উপায় হলো সাবান-জল দিয়ে ধোয়া। |
নাভির চারপাশে ১৪টি বেদনাদায়ক ইনজেকশন নিতে হয়। | এটি পুরনো দিনের কথা। বর্তমানে আধুনিক টিকা অনেক উন্নত এবং নিরাপদ, যা বাহুতে (intramuscular) বা চামড়ায় (intradermal) দেওয়া হয় এবং এর তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। |
সামান্য আঁচড়ে কিছু হয় না। | যদি আঁচড়ের ফলে চামড়া ছিঁড়ে যায়, তবে সেখান দিয়েও জলাতঙ্কের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই যেকোনো আঁচড়কেই গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। |
প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়
জলাতঙ্ক একটি ভয়াবহ রোগ, তবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এটি সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।
- পোষ্যকে টিকা দিন: আপনার বাড়ির পোষা বিড়াল বা কুকুরকে সময়মতো জলাতঙ্কের টিকা দিন এবং তার রেকর্ড রাখুন।
- রাস্তার প্রাণী থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন: রাস্তার বিড়াল বা কুকুরকে অকারণে বিরক্ত করবেন না বা তাদের কাছে যাবেন না।
- শিশুদের সতর্ক করুন: শিশুদের শেখান যেন তারা কোনো অজানা প্রাণীর সাথে খেলা না করে বা তাদের বিরক্ত না করে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: জলাতঙ্কের ঝুঁকি এবং কামড়ানোর পর করণীয় সম্পর্কে নিজে জানুন এবং অন্যদেরও সচেতন করুন।
শেষ কথা হলো, বিড়ালের কামড় বা আঁচড়কে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। সঠিক সময়ে টিকা নেওয়াই জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়। আপনার সামান্য সতর্কতা একটি ভয়াবহ রোগের হাত থেকে আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে রক্ষা করতে পারে।