Indoor air pollution sources: ঘরের ভিতরের বাতাসে দূষণের প্রধান উৎস হল রান্নার জন্য কাঠ, গোবর, কয়লা ইত্যাদি কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর প্রায় ৩.২ মিলিয়ন মানুষ ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণের কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করে। এই দূষণের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্টসহ নানা মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়ে।ঘরের ভিতরের বাতাসে দূষণের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উৎস হল:
- তামাকের ধোঁয়া
- পরিষ্কারক পণ্য
- ছত্রাক
- পোষা প্রাণীর লোম ও ত্বকের কণা
- রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত আসবাবপত্র ও নির্মাণ সামগ্রী
এই সমস্ত উৎস থেকে নির্গত ক্ষতিকর কণা ও গ্যাস শ্বাসনালী ও ফুসফুসে প্রদাহের সৃষ্টি করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং রক্তে অক্সিজেন বহন ক্ষমতা হ্রাস করে।
Indoor Air Pollution: প্রধান উৎসগুলি
রান্নার জ্বালানি
বিশ্বব্যাপী প্রায় ২.১ বিলিয়ন মানুষ এখনও রান্না, উত্তাপ ও আলোর জন্য কাঠ, গোবর, কৃষিজাত বর্জ্য ইত্যাদি কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করে। এগুলি পোড়ানোর ফলে নির্গত ধোঁয়া ও কণায় থাকে:
- ক্ষুদ্র কণিকা পদার্থ (PM2.5)
- কার্বন মনোক্সাইড
- নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড
- সালফার ডাই-অক্সাইড
- পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন
এই সব দূষক পদার্থ শ্বাসনালী ও ফুসফুসে প্রদাহের সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তামাকের ধোঁয়া
সিগারেট, সিগার ও পাইপের ধোঁয়া ঘরের ভিতরের বাতাসের অন্যতম মারাত্মক দূষক। এতে ৭,০০০ এরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৭০টি ক্যান্সারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। তামাকের ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে তা ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে।পরোক্ষ ধূমপানও (secondhand smoke) একটি গুরুতর সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর প্রায় ৭,৩০০ জন অধূমপায়ী প্রাপ্তবয়স্ক পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের ধোঁয়া ডিজেল গাড়ির নির্গমনের চেয়ে ১০ গুণ বেশি বায়ু দূষণ সৃষ্টি করে।
পরিষ্কারক পণ্য
অনেক পরিষ্কারক পণ্যে থাকা রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, যা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। এসব পণ্যে থাকা volatile organic compounds (VOCs) ঘরের তাপমাত্রায় সহজেই বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে মিশে যায়। VOCs শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, যকৃত, কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে।
ছত্রাক
ছত্রাক ঘরের ভিতরের বাতাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দূষক, যা শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি ও অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার কারণ হতে পারে। স্যাঁতসেঁতে ও আর্দ্র পরিবেশে ছত্রাক সহজেই বৃদ্ধি পায়। দেয়াল, মেঝে, ছাদ ও বেসমেন্টে ছত্রাক দেখা যেতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বা হাঁপানি বা অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে ছত্রাকের সংস্পর্শে আসা বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ।
পোষা প্রাণীর লোম ও ত্বকের কণা
পোষা প্রাণীর লোম, ত্বক ও লালার কণা (pet dander) ঘরের ভিতরের বাতাসের আরেকটি সাধারণ দূষক। এই কণাগুলি শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে হাঁপানি, হে-ফিভার ও অন্যান্য অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দিতে পারে। লোমযুক্ত প্রায় সব প্রাণীই এই ধরনের কণা ছড়ায়।
দিল্লির বায়ু দূষণ: AQI ৪০০ ছাড়াল, কঠোর ব্যবস্থা নিল প্রশাসন
Indoor Air Pollution: স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণের ফলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে:
হৃদরোগ
ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণের কারণে যে সব মৃত্যু হয়, তার ৩২% হৃদরোগের কারণে। প্রতি বছর প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ এর ফলে অকালে মারা যায়।
স্ট্রোক
ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণের কারণে মোট মৃত্যুর ২৩% স্ট্রোকের কারণে হয়।
নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ
ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণের সংস্পর্শে আসলে শিশুদের নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর ৪৪% এর কারণ হল ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণ।
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD)
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে প্রাপ্তবয়স্কদের COPD-জনিত মৃত্যুর ২৩% এর কারণ হল ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণের সংস্পর্শে আসা।
ফুসফুসের ক্যান্সার
প্রাপ্তবয়স্কদের ফুসফুসের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর প্রায় ১১% এর কারণ হল কেরোসিন বা কাঠ, কয়লা ইত্যাদি কঠিন জ্বালানি ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট ঘরের ভিতরের বায়ু দূষণের সংস্পর্শে আসা।
Indoor Air Pollution: প্রতিরোধের উপায়
ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণ কমানোর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে:
- পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহার: রান্না ও উত্তাপের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস, বৈদ্যুতিক চুলা ইত্যাদি পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহার করা।
- ভালো বায়ুচলাচল: ঘরে পর্যাপ্ত বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা করা, যাতে দূষিত বাতাস বের হয়ে যেতে পারে।
- ধূমপান নিষিদ্ধ: ঘরের ভিতরে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: নিয়মিত ঘর পরিষ্কার করা, বিশেষ করে ধুলো ও পোষা প্রাণীর লোম পরিষ্কার করা।
- আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ: ঘরের আর্দ্রতা ৩০-৫০% এর মধ্যে রাখা, যাতে ছত্রাক বৃদ্ধি না পায়।
- বায়ু পরিশোধক: প্রয়োজনে HEPA ফিল্টারযুক্ত বায়ু পরিশোধক ব্যবহার করা।
- প্রাকৃতিক উপায়ে বায়ু পরিশোধন: বিভিন্ন বায়ু পরিশোধক গাছ যেমন স্নেক প্ল্যান্ট, স্পাইডার প্ল্যান্ট ইত্যাদি ঘরে রাখা।
- রাসায়নিক পণ্য সীমিত ব্যবহার: VOCs
উক্ত পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করে আমরা ঘরের ভিতরের বাতাসের মান উন্নত করতে পারি এবং এর ফলে স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে পারি।
Indoor Air Pollution: বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী
ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সবার উপর একইভাবে পড়ে না। কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এর ফলে বেশি ঝুঁকিতে থাকে:
শিশু ও বৃদ্ধরা
শিশু ও বৃদ্ধদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। তাই তারা ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুদের ফুসফুস পূর্ণ বিকশিত না হওয়ায় তারা দূষিত বাতাসের কারণে সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।
গর্ভবতী মহিলারা
গর্ভবতী মহিলারা যদি দূষিত ঘরের বাতাসের সংস্পর্শে আসেন, তাহলে তাদের গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে শিশুর জন্মকালীন ওজন কম হওয়া, অকাল প্রসব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা
হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, হাঁপানি ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর ফলে তাদের রোগের লক্ষণ আরও বেড়ে যেতে পারে।
Indoor Air Pollution: আইনি ও নীতিগত পদক্ষেপ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে:
বাংলাদেশের উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে “ইন্ডোর এয়ার পলিউশন কন্ট্রোল স্ট্র্যাটেজি” প্রণয়ন করেছে। এর লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে সব পরিবারে পরিষ্কার জ্বালানি ও উন্নত চুলার ব্যবহার নিশ্চিত করা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা
ভারত সরকার ২০১৬ সালে “প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা” চালু করেছে। এর মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলিকে বিনামূল্যে এলপিজি সংযোগ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা কাঠ বা অন্যান্য কঠিন জ্বালানির পরিবর্তে পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহার করতে পারে।
চীনের Clean Heating Plan
চীন সরকার ২০১৭ সালে “Clean Heating Plan” চালু করেছে। এর লক্ষ্য হল ২০২১ সালের মধ্যে উত্তর চীনের ৭০% এলাকায় কয়লার পরিবর্তে পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
Indoor Air Pollution: গবেষণা ও উদ্ভাবন
ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণ কমানোর জন্য বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের গবেষণা ও উদ্ভাবনী কাজ চলছে:
উন্নত চুলা
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি কম দূষণকারী উন্নত চুলা তৈরির উপর কাজ করছে। এসব চুলায় জ্বালানি দক্ষতা বেশি থাকে এবং কম ধোঁয়া ও দূষণকারী পদার্থ নির্গত হয়।
স্মার্ট এয়ার পিউরিফায়ার
আধুনিক এয়ার পিউরিফায়ারগুলি ঘরের বাতাসের মান স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষা করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে। এগুলি স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
নানো-ম্যাটেরিয়াল ভিত্তিক ফিল্টার
বিজ্ঞানীরা নানো-ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে অত্যন্ত কার্যকর ফিল্টার তৈরির উপর গবেষণা করছেন। এসব ফিল্টার অতি ক্ষুদ্র কণাও ধরে রাখতে সক্ষম।
Indoor Air Pollution: সামাজিক প্রভাব
ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণের শুধু স্বাস্থ্যগত প্রভাবই নয়, এর সামাজিক প্রভাবও রয়েছে:
লিঙ্গ বৈষম্য
গ্রামীণ এলাকায় সাধারণত মহিলারাই রান্নার দায়িত্ব পালন করেন। ফলে তারা দূষিত ধোঁয়ার সংস্পর্শে বেশি আসেন। এভাবে ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণ লিঙ্গ বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
শিক্ষার উপর প্রভাব
দূষিত ঘরের বাতাসের কারণে শিশুরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর ফলে তাদের স্কুলে উপস্থিতি কমে যায় এবং শিক্ষার মান খারাপ হয়।
অর্থনৈতিক প্রভাব
ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণের কারণে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের কর্মক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে পরিবারের আয় কমে যায় এবং চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়।
ঘরের ভিতরের বাতাসের দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা, যা বিশ্বব্যাপী মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা, গবেষক ও সাধারণ মানুষ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহার, ভালো বায়ুচলাচল নিশ্চিত করা, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা ঘরের ভিতরের বাতাসের মান উন্নত করতে পারি। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্য, জীবনমান ও অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে।