মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘর্ষ চার দিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সমাপ্ত হলেও, এই ঘটনার পেছনে অনেক প্রশ্নই অনুত্তরিত রয়ে গেছে। পহেলগাঁওয়ে ২২ এপ্রিল সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালায় এবং পাকিস্তান পাল্টা ‘অপারেশন বুনিয়ান-উন-মারসুস’ শুরু করে। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে এই সংঘর্ষ বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করলেও, এর বেশ কিছু দিক এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
ভারত দাবি করেছে যে তারা পাকিস্তানের ৯টি শহরে মোট ২৪টি হামলা চালিয়ে লস্কর-ই-তাইয়েবা ও জইশ-ই-মুহাম্মদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করেছে এবং অন্তত ১০০ ‘সন্ত্রাসী’ হত্যা করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান দাবি করেছে যে তারা অন্তত ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে নতুন করে কেনা ফরাসি রাফালও রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় বিমানবাহিনীর এয়ার মার্শাল এ কে ভারতি এই দাবির সরাসরি জবাব দেননি, শুধু বলেছেন, “ক্ষতি যুদ্ধের অংশ”। এই পরস্পরবিরোধী দাবিগুলোর মধ্যে প্রকৃত সত্য এখনো অনিশ্চিত।
সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ভারত ফরাসি ও রুশনির্মিত যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে, আর পাকিস্তান ব্যবহার করেছে চীনের সঙ্গে তাদের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত জে-১০ ও জে-১৭ যুদ্ধবিমান। উভয় দেশই দাবি করেছে যে তাদের বিমানগুলি সীমান্ত অতিক্রম করেনি এবং দূরত্ব বজায় রেখে একে অপরের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু কয়েকটি সংবাদমাধ্যম পাঞ্জাব ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর দিয়েছে, যদিও ভারত সরকার এসব নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
হতাহতের সংখ্যা নিয়েও দু’পক্ষের দাবি আলাদা। পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৩১ জন নিহত এবং ৪৬ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় ১৫ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছেন। তবে অন্য কিছু সূত্র জানিয়েছে, ভারতের জম্মু ও পাঞ্জাব সীমান্ত এলাকায় অন্তত ৩০ সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। সেনা হতাহতের সঠিক সংখ্যা কোনো পক্ষই প্রকাশ করেনি।
সংঘর্ষের সময় যখন ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল, তখন হঠাৎ করে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার কারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন যে তিনি দুই দেশের সঙ্গেই বাণিজ্য থামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তাই সংঘর্ষবিরতি হয়েছে, যদিও ভারত এই দাবি অস্বীকার করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় যুদ্ধবিরতির পথ তৈরি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে এর পেছনে আরও গভীর কারণ থাকতে পারে।
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুত্তরিত প্রশ্ন হল ভারতের নূর খান বায়ুসেনা ঘাঁটিতে আঘাত হানার বিষয়টি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন যে ভারতের মিসাইল পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার রক্ষাকারী এই ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে। এমনকি ওই এলাকায় তেজস্ক্রিয়-রোধী উপকরণ বহনকারী একটি মিশরীয় বিমান দেখা গেছে, যদিও পরমাণু বিষয়ক নজরদারি সংস্থা জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কোনও খবর নেই। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, পরমাণু অস্ত্রের হুমকিই তাড়াতাড়ি সংঘর্ষবিরতি ঘোষণার অন্যতম কারণ হতে পারে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সংঘর্ষবিরতি-পরবর্তী বক্তৃতায় বলেছেন যে ভারতের আক্রমণের পর পাকিস্তান পরাজয় স্বীকার করেছে এবং তারপরেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা আধিকারিকদের বারবার আলোচনার জন্য ডেকেছে। তিনি আরও স্পষ্ট করেছেন, ভারত বারবার পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি সহ্য করবে না, কারণ এখন ভারত দেখিয়েছে যে তারা যে কোনও মুহূর্তে পাকিস্তানের পারমাণবিক ঘাঁটিতে পৌঁছতে পারে।
এই সংঘর্ষে সর্বাধিক লাভবান হয়েছে চীন – এমন বিশ্লেষণও সামনে এসেছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে চীন সরাসরি জড়িত না থাকলেও, পাকিস্তান চীন-নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছে। এতে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প অপ্রত্যাশিতভাবে লাভবান হয়েছে বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ফলে বিশ্বের সামরিক বাজারে চীনা অস্ত্রের চাহিদা বাড়তে পারে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন যে, পাকিস্তানের মতো একটি ‘জঙ্গি’ রাষ্ট্রের হাতে পরমাণু অস্ত্র তুলে দেওয়া কতটা সুরক্ষিত। এই মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তন করতে পারে।
সামরিক দিক থেকে, উভয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম, বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাডার ও যোগাযোগ অবকাঠামোতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি মেরামতে দুই দেশকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, যা তাদের অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধাক্কা দুই দেশের সামরিক ব্যয়ের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
আরেকটি অনুত্তরিত প্রশ্ন হল, ভারতের ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান’ কতটা সফল ছিল। ভারত দাবি করেছে যে তারা পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে এবং ১০০ জনেরও বেশি সন্ত্রাসী হত্যা করেছে। কিন্তু এই দাবির সত্যতা যাচাই করা কঠিন, কারণ স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো সেখানে প্রবেশাধিকার পায়নি। কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে ৯টি স্থাপনায় হামলা চালালেও, কথিত জঙ্গিরা অধরা রয়ে গেছে।
এই সংঘর্ষের পটভূমিতে দুই দেশের ঐতিহাসিক শত্রুতা ও কাশ্মীর সমস্যা রয়েছে। ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, পাহেলগামে ঘটে যাওয়া মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়, যা ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের উপর সবচেয়ে মারাত্মক আক্রমণ ছিল। ভারত এর জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গিদের দায়ী করে এবং ৭ মে রাতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়।
সামগ্রিকভাবে, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তন করতে পারে। চীনের বর্ধিত প্রভাব, পরমাণু অস্ত্রের হুমকি, এবং দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ ভবিষ্যতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সংঘর্ষের বহু প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকলেও, এটি স্পষ্ট যে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিবাদের সমাধান ছাড়া স্থায়ী শান্তি অসম্ভব।