বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্র বাঙালি সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য সময়। এই মাসে নীল পুজো, চড়ক পুজো এবং বাসন্তী পুজোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও লোকায়ত উৎসব পালিত হয়। ১৪৩১ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ২০২৫ সালের হিসেবে) এই পুজোগুলোর তারিখ ও তাৎপর্য পাঠকদের জন্য সহজে বোঝার মতো করে এখানে উপস্থাপন করা হলো। চৈত্র মাস মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে এবং এই সময়ে বাঙালিরা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বছরের শেষটাকে বিশেষভাবে উদযাপন করে।
চৈত্র মাসের বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে প্রথমে আসে নীল পুজো বা নীল ষষ্ঠী। এটি সাধারণত চৈত্র সংক্রান্তির ঠিক আগের দিন পালিত হয়। ২০২৫ সালে (১৪৩১ বঙ্গাব্দ) নীল ষষ্ঠী পড়বে ১১ এপ্রিল, শুক্রবার। এই দিনে মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় নির্জলা উপবাস করেন এবং সন্ধ্যায় মহাদেব শিবের পুজো করে উপবাস ভাঙেন। এরপরের দিন, ১২ এপ্রিল, শনিবার, চৈত্র সংক্রান্তির দিনে চড়ক পুজো অনুষ্ঠিত হবে। এটি শিবের গাজন উৎসবের একটি অংশ এবং গ্রামবাংলায় এর জনপ্রিয়তা অপরিসীম। এছাড়া, চৈত্র নবরাত্রির সময়ে বাসন্তী পুজো পালিত হয়, যা ২০২৫ সালে শুরু হবে ৩০ মার্চ থেকে এবং নবমী তিথিতে, ৭ এপ্রিল, রামনবমীর দিনে শেষ হবে। এই উৎসবগুলো বাঙালি সমাজে গভীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে।
নীল পুজোর কথা বলতে গেলে, এটি শিবের একটি বিশেষ আরাধনা। এই দিনে শিবকে নীলকণ্ঠ নামে পুজো করা হয় এবং মায়েরা সন্তানের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন। লোককথায় আছে, এক বামন দম্পতির সন্তান বারবার অকালে মারা যেত। মা ষষ্ঠী তাদের দুঃখ দেখে নীল ষষ্ঠীর ব্রত পালনের পরামর্শ দেন। তারা চৈত্র মাসে উপবাস করে শিবের পুজো করেন এবং তারপর থেকে তাদের সন্তানের কোনো ক্ষতি হয়নি। এই ঘটনা থেকেই নীল পুজোর প্রচলন শুরু হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। পুজোর সময় শিবলিঙ্গে দুধ, গঙ্গাজল, বেলপাতা ও ফল নিবেদন করা হয় এবং ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হয়।
চড়ক পুজোর ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি ভিন্ন রকমের উৎসব। এটি চৈত্রের শেষ দিনে শুরু হয় এবং কখনো কখনো বৈশাখের প্রথম দিন পর্যন্ত চলে। ২০২৫ সালে এটি ১২ এপ্রিল পড়ছে। এই পুজো শিবের গাজনের সঙ্গে যুক্ত এবং গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি প্রচলিত। চড়ক উৎসবে সন্ন্যাসীরা শরীরে কষ্টদায়ক আচার পালন করেন, যেমন বঁড়শি গেঁথে চড়ক গাছে ঝুলে থাকা বা আগুনে নৃত্য করা। তবে আধুনিক সময়ে এই বিপজ্জনক রীতিগুলো অনেক জায়গায় নিষিদ্ধ হয়েছে। এই উৎসবের উৎপত্তি বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা থেকে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন, যা পরে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মিশে গেছে।
বাসন্তী পুজো চৈত্র নবরাত্রির সময়ে পালিত হয়, যা দুর্গার বসন্তকালীন আরাধনা। ২০২৫ সালে এটি ৩০ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে মা দুর্গার নয়টি রূপের পুজো হয় এবং নবমীতে রামনবমী উদযাপিত হয়। বাঙালিরা এই পুজোকে শরতের দুর্গাপুজোর মতোই গুরুত্ব দেয়, তবে এটি তুলনামূলকভাবে ছোট পরিসরে পালিত হয়। এই পুজোর সময়ে মন্দিরে ভক্তদের ভিড় বাড়ে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এই তিনটি পুজোর পাশাপাশি চৈত্র মাসে আরো কিছু বিশেষ দিন রয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন স্নান, দান ও উপবাসের মতো কাজকে পুণ্যময় বলে মনে করা হয়। এছাড়া, এই মাসে বাংলা নববর্ষের প্রস্তুতি শুরু হয়, যা ১৩ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) পালিত হবে। চৈত্র মাস বাঙালি জীবনে ধর্ম, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটায়।
সব মিলিয়ে, চৈত্র মাস বাঙালির কাছে শুধু বছরের শেষ নয়, বরং নতুন শুরুর প্রতীক। নীল পুজোর মাধ্যমে সন্তানের মঙ্গল, চড়কের মাধ্যমে শিবভক্তির প্রকাশ এবং বাসন্তী পুজোর মাধ্যমে দুর্গার আরাধনা—এই সবই চৈত্রকে বিশেষ করে তোলে। তথ্যগুলো বাংলা পঞ্জিকা ও প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে, যা পাঠকদের জন্য নির্ভরযোগ্য ও সহজবোধ্য।