ভারতের আকাশে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হতে চলেছে। আগামী ৭-৮ সেপ্টেম্বর রাতে সংঘটিত হবে বছরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চন্দ্রগ্রহণ যা ‘ব্লাড মুন’ নামে পরিচিত। এই পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ ভারতের সকল অংশ থেকে দৃশ্যমান হবে এবং চাঁদ গভীর লাল রঙে আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
চন্দ্রগ্রহণের নির্দিষ্ট সময়সূচী
জ্যোতির্বিদদের মতে, ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৮টা ৫৮ মিনিটে (ভারতীয় মান সময়) শুরু হবে এই চন্দ্রগ্রহণ। গ্রহণের সবচেয়ে নাটকীয় অংশ অর্থাৎ পূর্ণতা পর্যায় চলবে রাত ১১টা থেকে রাত ১২টা ২২ মিনিট পর্যন্ত। সর্বোচ্চ গ্রহণ পর্যায় হবে রাত ১১টা ৪১ মিনিটে। গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে শেষ হবে ৮ সেপ্টেম্বর ভোরের দিকে ২টা ২৫ মিনিটে। সামগ্রিকভাবে এই গ্রহণের স্থায়িত্ব হবে ৩ ঘন্টা ২৮ মিনিট, যা বছরের অন্যতম দীর্ঘ চন্দ্রগ্রহণ।
ভারতের কোন কোন শহরে দেখা যাবে
এই চন্দ্রগ্রহণের অন্যতম বিশেষত্ব হল এটি ভারতের প্রায় সকল অংশ থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যাবে। উত্তর ভারতের দিল্লি, চণ্ডীগড়, জয়পুর, লখনউ থেকে শুরু করে পশ্চিম ভারতের মুম্বাই, আহমদাবাদ, পুনে এবং দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, কোচিতে এই মহাজাগতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যাবে। পূর্ব ভারতের কলকাতা, ভুবনেশ্বর, গুয়াহাটি এবং মধ্য ভারতের ভোপাল, নাগপুর, রায়পুরেও এই গ্রহণ দৃশ্যমান হবে।
কেন চাঁদ লাল রঙ ধারণ করে
বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ লাল রঙ ধারণ করার পেছনে রয়েছে ‘রেইলি স্ক্যাটারিং’ নামক পদার্থবিদ্যার একটি বিশেষ ঘটনা। যখন পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের মধ্যে অবস্থান করে, তখন সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে প্রতিসরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় নীল ও সবুজ আলোর তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু লাল ও কমলা রঙের দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছায়। ফলে চাঁদ গভীর লাল বা তামাটে রঙে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
গ্রহণ দেখার নিরাপদ উপায়
চন্দ্রগ্রহণ দেখার ক্ষেত্রে সূর্যগ্রহণের মতো বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন নেই। এটি খালি চোখেই নিরাপদভাবে দেখা যায় এবং কোনো প্রকার বিশেষ চশমা বা সুরক্ষা সামগ্রীর প্রয়োজন হয় না। তবে দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা টেলিস্কোপ ব্যবহার করলে আরও স্পষ্ট ও বিস্তারিত দৃশ্য উপভোগ করা যাবে। সর্বোত্তম দর্শনের জন্য আলোর দূষণ কম এমন খোলা জায়গা, ছাদ বা মাঠ বেছে নেওয়া উত্তম। মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া বা দূষণের কারণে কিছু এলাকায় দৃশ্যমানতা ব্যাহত হতে পারে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
হিন্দু ধর্মে চন্দ্রগ্রহণের বিশেষ ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। শাস্ত্রীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, চন্দ্রগ্রহণ রাহু ও কেতুর প্রভাবে সৃষ্টি হয় যা আধ্যাত্মিক শক্তির এক বিশেষ সময়। এই গ্রহণ পিতৃপক্ষের শুরুতে পড়ায় পূর্বপুরুষদের স্মরণ ও শ্রাদ্ধের জন্য এটি অত্যন্ত শুভ সময় হিসেবে বিবেচিত। অনেক মানুষ এই সময় উপবাস, মন্ত্রজপ ও ধ্যানে মগ্ন হন।
সুতক কাল ও পালনীয় নিয়মাবলী
ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, চন্দ্রগ্রহণের ৯ ঘন্টা পূর্ব থেকে সুতক কাল শুরু হয়। এ অনুসারে ৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ৫৭ মিনিট থেকে সুতক কাল আরম্ভ হবে এবং গ্রহণ শেষ পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে অনেকে খাদ্য গ্রহণ, রান্না বা শুভ কাজ থেকে বিরত থাকেন। বহু মন্দির এই সময় বন্ধ থাকে এবং গ্রহণ শেষে শুদ্ধীকরণ আচার সম্পন্ন করার পর পুনরায় খোলা হয়।
বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমানতা
এই চন্দ্রগ্রহণ শুধুমাত্র ভারতেই নয়, বিশ্বের ৭৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পারবে। এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং পূর্ব আমেরিকার বিভিন্ন অংশে এই গ্রহণ দৃশ্যমান হবে। এশিয়া ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় সর্বোত্তম দৃশ্য পাওয়া যাবে, যেখানে সম্পূর্ণ গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে।
আগামী গ্রহণসমূহ
২০২৫ সালে এটি দ্বিতীয় ও শেষ চন্দ্রগ্রহণ। বছরের প্রথম চন্দ্রগ্রহণ ১৪ মার্চে হয়েছিল কিন্তু সেটি ভারতে দৃশ্যমান ছিল না। পরবর্তী চন্দ্রগ্রহণ হবে ২০২৬ সালের ৩ মার্চে, যা ভারত থেকে আংশিকভাবে দেখা যাবে। এছাড়াও ২১ সেপ্টেম্বর একটি সূর্যগ্রহণ হবে কিন্তু সেটি ভারতে দৃশ্যমান হবে না।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উৎসাহ
বিজ্ঞানীরা এই গ্রহণকে গবেষণার এক অপূর্ব সুযোগ হিসেবে দেখছেন। এই সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে সূর্যালোকের প্রতিসরণ পর্যবেক্ষণ করে বায়ুমণ্ডলে ধূলিকণা, অ্যারোসল ও দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা যায়। এই গ্রহণের দীর্ঘ স্থায়িত্ব (৮২ মিনিট) এবং ব্যাপক দৃশ্যমানতা একে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।
ফটোগ্রাফি ও পর্যবেক্ষণের টিপস
চন্দ্রগ্রহণের ছবি তোলার জন্য বিশেষজ্ঞরা ট্রাইপড ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। ক্যামেরার ম্যানুয়াল সেটিংসে এক্সপোজার, আইএসও ও শাটার স্পিড সমন্বয় করে বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি তুলে রাখা উচিত। স্মার্টফোনেও ছবি তোলা যায় তবে ডিএসএলআর ক্যামেরার মান অনেক উন্নত হবে। দর্শকদের গ্রহণ শুরুর প্রায় ৭৫ মিনিট আগে থেকে পর্যবেক্ষণ শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যাতে আংশিক গ্রহণের পর্যায়ও দেখতে পাওয়া যায়।
বৈশ্বিক গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
এই চন্দ্রগ্রহণ শুধু একটি জ্যোতির্বিদ্যা ঘটনা নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক আগ্রহ ও প্রকৃতির প্রতি কৌতূহল জাগিয়ে তোলার এক অনন্য সুযোগ। প্রায় ৭ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পারবে, যা একে গত কয়েক দশকের অন্যতম ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান চন্দ্রগ্রহণে পরিণত করেছে। ভারতের বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা ও বিজ্ঞান কেন্দ্র এই অনুষ্ঠানে বিশেষ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিবেচনা
আধুনিক বিজ্ঞান স্পষ্ট করেছে যে চন্দ্রগ্রহণ একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক জ্যোতির্বিদ্যা ঘটনা এবং এর কোনো নেতিবাচক স্বাস্থ্য প্রভাব নেই। খাদ্য দূষণ বা ক্ষতিকর বিকিরণের ভয় সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবুও ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক প্রথা অনুসরণকারীরা তাদের প্রচলিত নিয়মাবলী মেনে চলতে পারেন।
এই দুর্লভ মহাজাগতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য দেশবাসীর প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। ৭-৮ সেপ্টেম্বর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেই দেখা মিলবে প্রকৃতির এই অপরূপ রহস্যময় দৃশ্যের, যা স্মৃতিতে চিরকালের জন্য গেঁথে থাকবে।