ISRO Chandrayaan-5 mission: চাঁদের রহস্যময় জগত আমাদের সবসময়ই টানে। তার শান্ত, রূপালি আলো যেমন আমাদের মুগ্ধ করে, তেমনই তার গভীরে লুকিয়ে থাকা গোপন রহস্যগুলো আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO (Indian Space Research Organisation) এই রহস্য উন্মোচনে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে। সম্প্রতি, কেন্দ্রীয় সরকার Chandrayaan-5 মিশনের জন্য অনুমোদন দিয়েছে, যা ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক হতে চলেছে। এই মিশন নিয়ে আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগছে? চাঁদের বুকে এবার কী নামবে? কীভাবে এই মিশন ভারতকে বিশ্বের সামনে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে? চলুন, এই লেখায় আমরা এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব এবং Chandrayaan-5-এর পেছনের গল্প জানব।
ভারতের মহাকাশ যাত্রায় Chandrayaan-5 আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই মিশনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি সবুজ সংকেত দিয়েছে, এবং ISRO-র বিজ্ঞানীরা এখন এটিকে বাস্তবায়িত করতে দিনরাত কাজ করে চলেছেন। এই মিশনের মূল লক্ষ্য হল চাঁদের পৃষ্ঠে নিরাপদে অবতরণ করা এবং সেখানকার মাটি ও পরিবেশ নিয়ে গভীর গবেষণা করা। এবারের মিশনে একটি শক্তিশালী রোভার (Rover) চাঁদে পাঠানো হবে, যার ওজন হবে ২৫০ কিলোগ্রাম। এটি Chandrayaan-3-এর তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বড় এবং আরও উন্নত প্রযুক্তিতে সজ্জিত। এই রোভার চাঁদের পৃষ্ঠে ঘুরে বেড়াবে, নমুনা সংগ্রহ করবে এবং পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুতি নেবে। এই মিশন শুধু চাঁদের গোপন রহস্য উন্মোচনই করবে না, ভবিষ্যতে মানব মিশনের পথও প্রশস্ত করবে।
চাঁদের মাটিতে পা রাখতে চলেছে ইউরোপের প্রথম রোভার “টেনেশিয়াস।”
ভারতের চন্দ্রাভিযানের গল্প শুরু হয়েছিল Chandrayaan-1 দিয়ে, যিনি ২০০৮ সালে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন যে ভারত মহাকাশ গবেষণায় কতটা সম্ভাবনা রাখে। এরপর Chandrayaan-2 এবং Chandrayaan-3 ভারতের দক্ষতাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। Chandrayaan-3, যিনি ২০২৩ সালে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম সফল অবতরণ করেছিলেন, তিনি ভারতকে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদে নরম অবতরণের কৃতিত্ব এনে দিয়েছেন। এই সাফল্যের পর ISRO-র বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেননি। তারা Chandrayaan-4-এর পরিকল্পনা করেছেন, যা চাঁদ থেকে নমুনা ফিরিয়ে আনার মিশন, এবং এখন Chandrayaan-5-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
Chandrayaan-5 মিশনটি শুধু চাঁদে যাওয়া বা অবতরণ করার জন্য নয়, এটি ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। এই মিশনের মাধ্যমে ISRO চাঁদের পৃষ্ঠে আরও গভীরভাবে গবেষণা করতে চায়। এবারের রোভারটি চাঁদের মাটি, পাথর এবং সম্ভাব্য জলের উৎস নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবে। এই তথ্যগুলো ভবিষ্যতে চাঁদে মানব বসতি স্থাপন বা মহাকাশযানের জন্য জ্বালানি তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ISRO-র চেয়ারম্যান এস সোমনাথ জানিয়েছেন যে, এই মিশনটি ভারতের চন্দ্র গবেষণার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে এবং ভবিষ্যতের মানব মিশনের জন্য পথ তৈরি করবে।
এই মিশনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হল এর রোভার। ২৫০ কিলোগ্রাম ওজনের এই রোভারটি Chandrayaan-3-এর রোভার Pragyan-এর তুলনায় অনেক বড় এবং শক্তিশালী। Pragyan-এর ওজন ছিল মাত্র ২৬ কিলোগ্রাম, যেখানে এই নতুন রোভারটি তার থেকে প্রায় ১০ গুণ বড়। এটি উন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত হবে, যা চাঁদের পৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে সক্ষম। এছাড়াও, এই মিশনে একটি ল্যান্ডার (Lander) থাকবে, যা রোভারটিকে চাঁদের পৃষ্ঠে নিরাপদে নামিয়ে দেবে। এই ল্যান্ডারটিও আগের মিশনগুলোর তুলনায় আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করবে।
Chandrayaan-5-এর সঠিক তারিখ এখনও ঘোষণা করা হয়নি। তবে, ISRO-র তরফে জানানো হয়েছে যে এটি Chandrayaan-4-এর পরে চালু হবে। Chandrayaan-4, যা একটি নমুনা ফিরিয়ে আনার মিশন, ২০২৭ সালের দিকে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে। সুতরাং, Chandrayaan-5 সম্ভবত ২০২৮ বা ২০২৯ সালে চাঁদের উদ্দেশে রওনা দিতে পারে। এই সময়ের মধ্যে ISRO তাদের প্রযুক্তি আরও উন্নত করবে এবং পূর্ববর্তী মিশনগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এটিকে সফল করার জন্য প্রস্তুতি নেবে।
Chandrayaan-5 শুধু একটি মিশন নয়, এটি ভারতের মহাকাশ গবেষণায় দক্ষতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চিনের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি ভারত এখন মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে নিজেকে একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। Chandrayaan-3-এর সাফল্যের পর বিশ্বের দৃষ্টি এখন ভারতের দিকে। এই মিশন সফল হলে ভারত চাঁদে দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে, যা ভবিষ্যতে মানব মিশন বা চন্দ্র বসতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চাঁদের পৃষ্ঠে জলের উৎস, খনিজ পদার্থ এবং অন্যান্য সম্পদের সম্ভাবনা রয়েছে। Chandrayaan-1 ইতিমধ্যেই চাঁদে জলের অণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিল। Chandrayaan-5-এর রোভার এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। যদি চাঁদে জল বা জ্বালানি তৈরির উপাদান পাওয়া যায়, তবে তা মহাকাশযানের জন্য জ্বালানি সরবরাহ বা মানব বসতির জন্য অক্সিজেন তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মিশনের জন্যও পথ সুগম করবে।
ISRO-র দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হল চাঁদে মানব মিশন পাঠানো। Chandrayaan-5 এই স্বপ্নের দিকে আরেকটি পদক্ষেপ। এই মিশনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি এবং সংগৃহীত তথ্য ভবিষ্যতে মানুষকে চাঁদে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে। এছাড়াও, এটি ভারতের Gaganyaan প্রোগ্রামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করবে, যা ভারতের প্রথম মানব মহাকাশ মিশন।
Chandrayaan-5-এ ISRO তাদের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। রোভারটি শুধু চাঁদের পৃষ্ঠে ঘুরবে না, এটি নমুনা সংগ্রহ করার জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত হবে। ল্যান্ডারটি চাঁদের কঠিন ভূখণ্ডে নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও, এই মিশনে LVM3 (Launch Vehicle Mark-III) রকেট ব্যবহার করা হবে, যা ISRO-র সবচেয়ে শক্তিশালী লঞ্চার। এই রকেটটি ইতিমধ্যেই Chandrayaan-3-কে সফলভাবে চাঁদে পৌঁছে দিয়েছে।
ভারত এই মিশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উপরও নির্ভর করতে পারে। Chandrayaan-3-এর সময় NASA এবং ESA (European Space Agency)-এর সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। Chandrayaan-5-এও এই ধরনের সহযোগিতা দেখা যেতে পারে, যা মিশনের সাফল্যের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেবে।
ISRO-র বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতা এই মিশনের সবচেয়ে বড় শক্তি। Chandrayaan-2-এর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা Chandrayaan-3-কে সফল করেছেন। এই অভিজ্ঞতা Chandrayaan-5-এর জন্যও কাজে আসবে। প্রতিটি মিশনে তারা নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা করে এবং পূর্ববর্তী ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যায়।
চাঁদে তৈরি হবে বিপন্ন প্রাণীদের ‘বায়োরিপোজিটরি’
Chandrayaan-5 শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য গর্বের বিষয়। এটি আমাদের দেখায় যে ভারত কতটা এগিয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে কতটা এগোতে পারে। আপনি যদি মহাকাশ গবেষণায় আগ্রহী হন, তবে এই মিশন আপনাকে নতুন কিছু শেখার সুযোগ দেবে। এছাড়াও, এটি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। ভবিষ্যতে হয়তো আপনার সন্তান বা আত্মীয়ও ISRO-র মতো সংস্থায় কাজ করে দেশের গর্ব বাড়াতে পারে।
Chandrayaan-5 মিশন ভারতের মহাকাশ গবেষণার একটি নতুন অধ্যায়। এটি শুধু চাঁদে যাওয়ার গল্প নয়, এটি ভারতের স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দক্ষতার প্রতিফলন। ISRO-র বিজ্ঞানীরা যে কঠোর পরিশ্রম করছেন, তা আমাদের সবাইকে গর্বিত করে। এই মিশন সফল হলে ভারত বিশ্বের কাছে আরও একবার প্রমাণ করবে যে আমরা শুধু স্বপ্ন দেখি না, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেও জানি। তাই, চাঁদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসুন, কারণ সেখানে ভারতের পতাকা আরও উজ্জ্বলভাবে উড়তে চলেছে।