বিশ্বের দুই পরাশক্তি চীন ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সম্প্রতি চীনের দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, তারা আমেরিকার সঙ্গে “যেকোনো ধরনের যুদ্ধের” জন্য প্রস্তুত। এই হুঁশিয়ারি এসেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর। অন্যদিকে, আমেরিকার প্রতিরক্ষা দপ্তরও জানিয়েছে, তারা এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি। এরই মধ্যে ডিপসিকের পর আলিবাবার বাজারে প্রত্যাবর্তন নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
গত কয়েক বছর ধরে চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা ক্রমাগত বেড়েছে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে এসে এই দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমস্ত চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এর জবাবে চীনের ওয়াশিংটন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, “যদি আমেরিকা যুদ্ধ চায়—তা শুল্কযুদ্ধ হোক, বাণিজ্যযুদ্ধ হোক বা অন্য কিছু—আমরা শেষ পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত।” এই বক্তব্যের পর পরই আমেরিকার প্রতিরক্ষাসচিব পিট হ্যাগসিট ফক্স নিউজকে বলেছেন, “আমরা একটি বিপজ্জনক বিশ্বে বাস করছি, যেখানে শক্তিশালী দেশগুলো আমাদের জায়গা দখল করতে চায়। আমরাও প্রস্তুত।”
এদিকে, চীনও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকান পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই ঘটনাপ্রবাহে বাণিজ্যযুদ্ধ যে শুধু অর্থনৈতিক স্তরে থেমে থাকবে না, তা নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই উত্তেজনা সামরিক সংঘাতের দিকেও গড়াতে পারে। এর মধ্যে চীনের প্রযুক্তি জায়ান্ট আলিবাবা, ডিপসিকের (ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম) পর বাজারে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। আলিবাবার এই প্রত্যাবর্তন বিশ্ব বাজারে চীনের অবস্থান শক্ত করতে ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয়েছিল, যখন ট্রাম্প প্রথম চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ান। ২০২০ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও, ২০২৫ সালে এসে আবার তা তীব্র হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দ্বন্দ্বের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ কমতে পারে। চীন বর্তমানে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, এবং দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার।
আলিবাবার প্রসঙ্গে বলতে গেলে, এই কোম্পানি চীনের অর্থনীতির একটি বড় অংশ। ডিপসিকের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের মাধ্যমে আলিবাবা বিশ্ব বাজারে নিজের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে আমেরিকার সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে এর বাজারে ফেরা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে বড় চাপে রয়েছে।
এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য কী বোঝায়? চীন ও আমেরিকার ঝগড়া বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে। যেমন, চীন থেকে আমদানি করা ইলেকট্রনিক্স বা পোশাকের দাম বেড়ে গেলে আমাদের পকেটে টান পড়বে। আবার আমেরিকার কৃষিপণ্য চীনে কম গেলে সেখানকার মানুষেরও ক্ষতি হবে। আলিবাবার বাজারে ফেরার চেষ্টা চীনের জন্য একটি আশার আলো হতে পারে, কিন্তু আমেরিকার চাপে তা কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোও এই দ্বন্দ্বের প্রভাব থেকে বাদ যাবে না। বাংলাদেশের মতো দেশ, যারা চীন ও আমেরিকা দুই দেশের সঙ্গেই ব্যবসা করে, তাদের জন্য এটা চিন্তার বিষয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি স্বল্পমেয়াদে লাভবান হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।
চীন ও আমেরিকার এই টানাপোড়েন কোনো সাধারণ ঝগড়া নয়। এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক আধিপত্য ও ক্ষমতার লড়াই। চীন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে বাণিজ্যযুদ্ধে তারা পিছপা হবে না, সেটা পরিষ্কার। আলিবাবার বাজারে ফেরা চীনের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে, কিন্তু আমেরিকার চাপ তা কঠিন করে তুলছে। এই পরিস্থিতি বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা সময়ই বলবে।