বাংলাদেশের চট্টগ্রামে একটি দুর্গাপূজা মণ্ডপে ইসলামী সংগীত পরিবেশনের ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল (১০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে এই ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি নামের একটি সংগঠনের ৬ জন সদস্য মঞ্চে উঠে দুটি গান পরিবেশন করে, যার একটি ছিল ইসলামী ভাবধারার।
পরিবেশিত গান দুটি হল বাউল শাহ আবদুল করিমের “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” এবং চৌধুরী আবদুল হালিমের “শুধু মুসলমানের লাগি আসেনি ইসলাম”। দ্বিতীয় গানটির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিতর্কের সৃষ্টি করে।
এই ঘটনার পর চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার ফরিদা খানম জানিয়েছেন, যারা মঞ্চে উঠে গান গেয়েছে তাদের ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, “তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে”।
পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুকান্ত মহাজন তুতুল জানিয়েছেন, ওই যুবকরা প্রথমে জানিয়েছিল তারা একটি দেশাত্মবোধক গান গাইবে। কিন্তু পরে তারা দুটি গান গায়, যার একটি ছিল ইসলামী সংগীত।
এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। অনেকে এটিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তবে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির সভাপতি সেলিম জামান দাবি করেছেন, তারা পূজা কমিটির আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এই ধরনের ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে এ বছর ৩২,৬৬৬টি দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় সামান্য বেশি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে ২০ দিনে ২,০১০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে অনেক পূজা কমিটি এবার উৎসব পালনে সতর্কতা অবলম্বন করছে। কেউ কেউ জানিয়েছেন, তারা হুমকি পেয়েছেন এবং মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়েছে উৎসব নির্বিঘ্নে পালনের জন্য।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, এটি সকল সম্প্রদায়ের উৎসব। অসত্যের বিনাশ ও সত্যের জয় এই উৎসবের মূল বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আমাদের সংবিধান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অধিকার রক্ষা করে”।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক মন্তব্য করেছেন, “আওয়ামী লীগের শাসনামলেও দুর্গাপূজায় হামলা হয়েছে, মূর্তি ভাঙচুর হয়েছে। আমি অবাক হব না যদি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই এই বর্তমান হামলার পিছনে থাকে, যাতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বদনাম করা যায় এবং এমন একটা ছবি আঁকা যায় যে শেখ হাসিনা ছাড়া হিন্দুরা বিপদে আছে”।
এদিকে, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ড. শফিকুর রহমান সম্প্রতি ঢাকায় এক বক্তৃতায় বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার তার দলকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছে।
চট্টগ্রামে এই ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন কড়া নজরদারি শুরু করেছে। পূজা কমিটির সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এই ঘটনা তাদের মর্মাহত করেছে এবং যে ব্যক্তি মঞ্চ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাকে সাসপেন্ড করা হবে।
চট্টগ্রামে এবার ২,৪৫৮টি স্থানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যার মধ্যে শহরে ২৯৩টি এবং ১৫টি উপজেলায় ২,১৬৫টি পূজামণ্ডপ রয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহরে প্রায় ২,০০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এই ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকার এবং সামাজিক সংগঠনগুলো এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়, যারা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী, তারা বিভিন্ন ধরনের হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন।
গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে দেশজুড়ে সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে শতাধিক পরিবার আক্রমণের শিকার হয়েছে, সাবোটাজের ঘটনা ঘটেছে এবং মৃত্যুর হুমকি পেয়েছে। এছাড়া দেশের ৪৫টি জেলায় ১৫টিরও বেশি হিন্দু মন্দির ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের শিকার হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দুর্গাপূজা উদযাপন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক পূজা কমিটি তাদের উৎসব ছোট আকারে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেউ কেউ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় তহবিল ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দুর্গাপূজার জন্য জাতীয় ছুটি চার দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা একটি বিরল ঘটনা। এছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
তবে সরকারের এই পদক্ষেপগুলো শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতির তুলনায় যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও ২০২১ সালে হাসিনার সরকার পূজামণ্ডপে মৌলবাদীদের হামলার ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, তবুও সাধারণভাবে মনে করা হত যে আওয়ামী লীগ হিন্দুদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল।