বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সাথে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজারের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভ্রমণপিপাসু মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করে এই রুটে চালু হয়েছে একাধিক ট্রেন পরিষেবা, যা ভ্রমণকে করেছে আরও সহজ, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী। এই প্রবন্ধে আমরা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের ট্রেনের সময়সূচী, ভাড়ার তালিকা, এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত সকল খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যা আপনার আগামী ভ্রমণের সেরা সঙ্গী হবে। Chittagong to Cox’s Bazar train ticket price & Schedule সর্বশেষ তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো।
এক নতুন দিগন্তের সূচনা
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় পর্যটন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। সড়ক পথের যানজট ও দীর্ঘ ক্লান্তি এড়িয়ে এখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার আরামদায়ক ট্রেন যাত্রার মাধ্যমে সৈকতের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে এই রুটে একাধিক আন্তঃনগর এবং লোকাল ট্রেন পরিচালনা করছে, যা সব শ্রেণীর যাত্রীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এই পরিষেবা চালুর পর থেকে, পর্যটকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নতুন ট্রেন চালুর প্রথম দিনেই কক্সবাজার স্টেশন থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার টিকেট বিক্রি হয়েছিল, যা এই রুটের জনপ্রিয়তাকে প্রমাণ করে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের ট্রেন পরিষেবা: প্রেক্ষিত ও বর্তমান অবস্থা
পূর্বে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার একমাত্র নির্ভরযোগ্য পথ ছিল সড়কপথ, যা প্রায়শই দীর্ঘ যানজট এবং অনিশ্চয়তার কারণে ভ্রমণকারীদের জন্য ক্লান্তিকর ছিল। এই সমস্যা সমাধানে সরকার দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণের একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। বহু প্রতীক্ষার পর, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এই রুটে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চালু হলেও, যাত্রীদের ব্যাপক চাহিদার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম থেকেও একাধিক ট্রেন চালু করা হয়। বর্তমানে এই রুটে কক্সবাজার এক্সপ্রেস, পর্যটন এক্সপ্রেস, সৈকত এক্সপ্রেস এবং প্রবাল এক্সপ্রেস নামক ট্রেনগুলো নিয়মিত চলাচল করছে।
আইকনিক ঝিনুক আকৃতির কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশন
এই রুটের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো কক্সবাজারের ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। আন্তর্জাতিক মানের এই স্টেশনটি নিজেই একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ২৯ একর জমির উপর নির্মিত এই ছয়তলা বিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেশনটিতে রয়েছে তারকা মানের হোটেলের সুবিধা, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, এবং বিশাল পার্কিং ব্যবস্থা। পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে এখানে লকার এবং লাগেজ রাখার সুব্যবস্থাও রয়েছে
সর্বশেষ আপডেট: ট্রেনের সময়সূচী ও ভাড়ার তালিকা (সেপ্টেম্বর ২০২৫)
ভ্রমণ পরিকল্পনার सबसे গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ট্রেনের সময়সূচী ও ভাড়ার সঠিক তথ্য জানা। নিচে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এবং কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম রুটের ট্রেনগুলোর সর্বশেষ সময়সূচী ও ভাড়ার তালিকা বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার ট্রেনের সময়সূচী
ট্রেনের নাম | ছাড়ার স্টেশন | ছাড়ার সময় | পৌঁছানোর স্টেশন | পৌঁছানোর সময় | সাপ্তাহিক বন্ধ |
কক্সবাজার এক্সপ্রেস (৮১৪) | চট্টগ্রাম | ভোর ৪:০০ | কক্সবাজার | সকাল ৬:৪০ | – |
পর্যটন এক্সপ্রেস (৮১৬) | চট্টগ্রাম | সকাল ১১:৪০ | কক্সবাজার | বিকাল ৩:০০ | – |
সৈকত এক্সপ্রেস (৮২১) | চট্টগ্রাম | সকাল ৬:১৫ | কক্সবাজার | সকাল ৯:৫৫ | সোমবার |
প্রবাল এক্সপ্রেস (৮২২) | চট্টগ্রাম | বিকাল ৩:১০ | কক্সবাজার | সন্ধ্যা ৭:০০ | সোমবার |
কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম ফেরার ট্রেনের সময়সূচী
ট্রেনের নাম | ছাড়ার স্টেশন | ছাড়ার সময় | পৌঁছানোর স্টেশন | পৌঁছানোর সময় | সাপ্তাহিক বন্ধ |
কক্সবাজার এক্সপ্রেস (৮১৩) | কক্সবাজার | – | চট্টগ্রাম | বিকাল ৩:৪০ | – |
পর্যটন এক্সপ্রেস (৮১৫) | কক্সবাজার | রাত ৮:০০ | চট্টগ্রাম | রাত ১০:৫০ | – |
প্রবাল এক্সপ্রেস | কক্সবাজার | সকাল ১০:৩৫ | চট্টগ্রাম | দুপুর ২:১৫ | সোমবার |
সৈকত এক্সপ্রেস (৮২৪) | কক্সবাজার | রাত ৮:১৫ | চট্টগ্রাম | রাত ১১:৫০ | সোমবার |
দ্রষ্টব্য: কক্সবাজার এক্সপ্রেস এবং পর্যটন এক্সপ্রেস মূলত ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে চলাচল করে এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে একটি নির্দিষ্ট সময় বিরতি দেয়। উপরের তালিকায় চট্টগ্রাম থেকে যাত্রার সময় উল্লেখ করা হয়েছে।
Chittagong to Cox’s Bazar train ticket price (ভাড়ার তালিকা)
বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রীদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর টিকিটের ব্যবস্থা রেখেছে। নিচে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের বিভিন্ন শ্রেণীর ভাড়ার একটি আনুমানিক তালিকা দেওয়া হলো:
শ্রেণী | ভাড়া (আনুমানিক) |
শোভন চেয়ার | ২২০ – ২৫০ টাকা |
স্নিগ্ধা (এসি চেয়ার) | ৪১৪ – ৪৭০ টাকা |
প্রথম শ্রেণীর চেয়ার | ৩৩৪ টাকা |
এসি বার্থ | ৭৪৮ টাকা |
২য় শ্রেণী (সাধারণ) | ৫৫ টাকা |
দ্রষ্টব্য: এই ভাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী। অনলাইন সার্ভিস চার্জ এবং অন্যান্য চার্জ প্রযোজ্য হতে পারে। ভ্রমণের পূর্বে বাংলাদেশ রেলওয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সর্বশেষ তথ্য যাচাই করে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সমাজের উপর প্রভাব ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ শুধুমাত্র ভ্রমণকেই সহজ করেনি, বরং এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবও রয়েছে।
- পর্যটন শিল্পের বিকাশ: এই রেল পরিষেবা চালুর ফলে কক্সবাজারে পর্যটকদের আগমন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য পর্যটন-সম্পর্কিত ব্যবসার প্রসার ঘটছে।
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি: পর্যটন শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে স্থানীয় মানুষের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
- কৃষিপণ্যের সহজ পরিবহন: এই রেললাইন ব্যবহার করে কক্সবাজার এবং আশেপাশের অঞ্চলের কৃষিপণ্য, লবণ এবং মাছ সহজে ও কম খরচে সারাদেশে পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।
- আঞ্চলিক সংযোগ: এই রেললাইনটি ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের একটি অংশ, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করবে এবং বাণিজ্য প্রসারে ভূমিকা রাখবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সুপারিশ
এই রেল রুটের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ভবিষ্যতে এই রুটে আরও বেশি ট্রেন চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য বিশেষ ট্যুরিস্ট কোচ সংযোজন এবং ছুটির দিনগুলোতে অতিরিক্ত ট্রেন পরিচালনার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারে। যাত্রীসেবার মান উন্নত করতে এবং টিকেট কালোবাজারি রোধে অনলাইন টিকেট ব্যবস্থাপনাকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
১. চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে ট্রেনে কত সময় লাগে?
উত্তর: চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে ট্রেনে প্রায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে, যা ট্রেনের ধরন এবং বিরতির উপর নির্ভর করে।
২. চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের ট্রেনের টিকেট কিভাবে কিনব?
উত্তর: বাংলাদেশ রেলওয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (railway.gov.bd), রেল সেবা অ্যাপ অথবা রেলওয়ে স্টেশন কাউন্টার থেকে সরাসরি টিকেট কেনা যাবে।
৩. Chittagong to Cox’s Bazar train ticket price সর্বনিম্ন কত?
উত্তর: এই রুটে ২য় শ্রেণীর সাধারণ কোচের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫৫ টাকা এবং শোভন চেয়ারের ভাড়া প্রায় ২২০ টাকা থেকে শুরু।
৪. এই রুটে কি এসি কোচ আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, এই রুটে স্নিগ্ধা (এসি চেয়ার) এবং এসি বার্থের মতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচের ব্যবস্থা রয়েছে।
৫. চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর নাম কি?
উত্তর: এই রুটে বর্তমানে কক্সবাজার এক্সপ্রেস, পর্যটন এক্সপ্রেস, সৈকত এক্সপ্রেস এবং প্রবাল এক্সপ্রেস নামক ট্রেনগুলো চলাচল করছে।
উপসংহার
নিঃসন্দেহে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ বাংলাদেশের যোগাযোগ এবং পর্যটন খাতে একটি মাইলফলক। এটি কেবল দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের দূরত্বই কমায়নি, বরং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই রেল পরিষেবা ভবিষ্যতে আরও উন্নত হবে এবং দেশের পর্যটন শিল্পকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। আপনার পরবর্তী কক্সবাজার ভ্রমণের জন্য ট্রেন হতে পারে একটি আদর্শ এবং আনন্দদায়ক মাধ্যম।