পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিভিক ভলান্টিয়ারদের জন্য একটি বৃহৎ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তর বাংলা ও কলকাতা পুলিশের সাথে সংযুক্ত ১.২ লক্ষ সিভিক ভলান্টিয়ারের জন্য ৪৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে চলেছে। এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হল তাদের সংবেদনশীল করে তোলা, শৃঙ্খলাবদ্ধ করা এবং বিভিন্ন নিয়ম-কানুন শেখানো যাতে তারা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে পারে এবং পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ না করে।
সম্প্রতি সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিভিন্ন অপরাধের জন্য গ্রেপ্তারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর জি কার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনা সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
Civic Police Recruitment 2024: ১১,৭৪৯ পদে নতুন নিয়োগের সুযোগ, জেনে নিন বিস্তারিত
নবান্নের সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবিত প্রশিক্ষণ আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি চান যে সিভিক ভলান্টিয়াররা যথাযথ প্রশিক্ষণ পেয়ে দক্ষতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করুক।
প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে মূলত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনসংযোগ দক্ষতা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, সংকট মোকাবিলা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এছাড়াও নৈতিকতা, সততা ও দায়িত্বশীলতার মতো বিষয়গুলিও প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সিভিক ভলান্টিয়ারদের মধ্যে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে।
সিভিক ভলান্টিয়ার স্কিমটি ২০০৮ সালে সিপিএম সরকারের আমলে শুরু হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে কলকাতার ব্যস্ততম চৌমাথাগুলিতে ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করার জন্য কয়েকজন কলেজ ছাত্রকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এই স্কিমকে বিস্তৃত করে। বর্তমানে রাজ্যে প্রায় ১.২ লক্ষ সিভিক ভলান্টিয়ার রয়েছে।
তবে এই স্কিম নিয়ে বিতর্কও কম নয়। অভিযোগ উঠেছে যে অনেক ক্ষেত্রে শাসক দলের কর্মীদের পুরস্কৃত করার জন্য এই পদে নিয়োগ করা হয়। এছাড়া সিভিক ভলান্টিয়ারদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, তাদের ভূমিকা ও দায়িত্বের অস্পষ্টতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কলকাতা হাইকোর্ট ২০১৬ সালে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। আদালত বলেছিল যে সরকার “পছন্দসই ব্যক্তিদের বেছে নেওয়ার” নীতি অনুসরণ করছে। এরপর থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছুটা স্বচ্ছতা আনা হলেও সমস্যা পুরোপুরি মেটেনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এই স্কিম বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং সিভিক ভলান্টিয়ারদের পেশাগত উন্নয়নের সুযোগের অভাব। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সিভিক ভলান্টিয়াররা স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত যুবক যারা নিয়মিত নিয়োগপ্রাপ্ত নয় এবং সাধারণ কনস্টেবলদের মতো কোনো প্রশিক্ষণও পায়নি। ফলে তারা অপরাধ বা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর বা সক্ষম নয়।”
এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে শুধু প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, তাদের ভূমিকা ও দায়িত্বের সুনির্দিষ্ট নির্ধারণ এবং কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সিভিক ভলান্টিয়ারদের মাসিক সম্মানী বর্তমানে প্রায় ৯,০০০ টাকা। এই অল্প আয়ে অনেকেই সংসার চালাতে পারেন না। ফলে অনেক সময় তারা অন্যায্য উপায়ে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সিভিক ভলান্টিয়ারদের জন্য একটি কার্যকর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। যারা ভালো কাজ করছেন তাদের পুরস্কৃত করা এবং যারা অসদাচরণ করছেন তাদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এর ফলে তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে।
Paris Olympic 2024: প্যারিসের অলিম্পিকে নিরাপত্তার দায়িত্বে ভারতীয় K9 বাহিনী
সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বর্তমানে তাদের নিয়োগের জন্য নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস। এটি বাড়িয়ে কমপক্ষে দশম শ্রেণি পাস করা উচিত। এছাড়া নিয়োগের সময় তাদের পূর্ব ইতিহাস যাচাই করা, মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা পরীক্ষা করা এবং একটি কঠোর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করা উচিত।
সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা প্রয়োজন। অনেক সময় দেখা যায় যে মানুষ তাদের নিয়মিত পুলিশ কর্মী ভেবে ভুল করে। এর ফলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো দরকার।
সামগ্রিকভাবে, সিভিক ভলান্টিয়ার স্কিমটি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে এটি পুলিশ প্রশাসনের জন্য একটি কার্যকর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, কঠোর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ। নতুন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এই লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এর সফল বাস্তবায়ন হলে পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে এবং জনগণের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেতে পারে।