উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনায় একটি স্কুলের সমৃদ্ধি ও খ্যাতি বৃদ্ধির জন্য ২য় শ্রেণির এক ছাত্রকে কথিত “মানব বলি” দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় স্কুলের মালিক সহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, গত ২২ সেপ্টেম্বর DL পাবলিক স্কুলের হোস্টেল রুমে কৃতার্থ কুশওয়াহা নামে ২য় শ্রেণির এক ছাত্রকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। স্কুলের মালিক যশোধন সিং, তার ছেলে ও স্কুলের পরিচালক দীনেশ বাঘেল, প্রধান শিক্ষক লক্ষ্মণ সিং এবং দুই শিক্ষক রামপ্রকাশ সোলাঙ্কি ও বীরপাল সিংকে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশের বরাত দিয়ে জানা গেছে, স্কুলের মালিক যশোধন সিং তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে একটি মানব বলি দিলে স্কুলের সমৃদ্ধি আসবে এবং তাদের পরিবারের উন্নতি হবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি তার ছেলে দীনেশকে একটি শিশুকে বলি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সিরিঞ্জের নেশায় বুঁদ ত্রিপুরা: HIV মহামারীর ছায়ায় হাজার হাজার তরুণ
অভিযুক্তরা প্রথমে ৬ সেপ্টেম্বর একটি শিশুকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই শিশুটি চিৎকার করে উঠলে তারা ব্যর্থ হয়। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর তারা কৃতার্থকে টিউবওয়েলের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পথে কৃতার্থ জেগে উঠলে তারা ভয় পেয়ে স্কুলের ভিতরেই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
হত্যাকাণ্ডের পর অভিযুক্তরা কৃতার্থের পরিবারকে জানায় যে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সন্দেহজনক আচরণে কৃতার্থের পরিবার পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ স্কুল পরিচালকের গাড়িতে কৃতার্থের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
ময়নাতদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে কৃতার্থকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে এবং তার গলার হাড় ভেঙে গেছে। পুলিশ স্কুল প্রাঙ্গণে তান্ত্রিক উপকরণ ও ধর্মীয় ছবি উদ্ধার করেছে যা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হচ্ছে[4]।
হাথরাসের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অশোক কুমার সিং জানিয়েছেন, অভিযুক্তরা স্বীকার করেছে যে তারা স্কুল ও পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য কৃতার্থকে বলি দিয়েছিল। তিনি আরও জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩-এর ১০৩(১) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
কৃতার্থের বাবা কৃষ্ণ কুমার জানিয়েছেন, স্কুল থেকে তাকে ফোন করে জানানো হয়েছিল যে তার ছেলের অবস্থা খুবই খারাপ এবং তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরে তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের গাড়িতে তার ছেলের মৃতদেহ দেখতে পান।
এই ঘটনা স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন যে কীভাবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই ধরনের ঘটনা সমাজে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের গভীর শিকড়ের ইঙ্গিত দেয়।
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এই ঘটনা শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই ধরনের ঘটনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অভিভাবক ও ছাত্রদের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।
মানবাধিকার কর্মীরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তারা দাবি করেছেন যে শুধু অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া নয়, বরং সমাজে এই ধরনের কুসংস্কার দূর করার জন্য ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে।
রাজ্য সরকার এই ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হবে এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
পুলিশ জানিয়েছে, তারা এই ঘটনার সাথে জড়িত অন্য কেউ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে। তারা স্কুলের অন্যান্য কর্মচারী ও ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে এবং স্কুলের রেকর্ড খতিয়ে দেখছে।
এই ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে ভারতের কিছু অংশে এখনও কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস গভীরভাবে শেকড় গেড়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে শুধু আইনি ব্যবস্থা নয়, সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার ঘটানো জরুরি।
শিক্ষাবিদরা সুপারিশ করছেন যে স্কুল পাঠ্যক্রমে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার উপর আরও জোর দেওয়া উচিত। এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন।
শহিদ দিবস বনাম গণতন্ত্র হত্যা দিবস: ২১ শে জুলাই পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিজেপির প্রতিবাদ
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই ধরনের ঘটনা সমাজে গভীর মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। তারা সুপারিশ করছেন যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা জোরদার করা উচিত।
অনেক সমাজকর্মী মনে করছেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে সমাজের নিম্ন স্তরে এখনও শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। তারা দাবি করছেন যে সরকারকে শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারা সরকারকে এই বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সামগ্রিকভাবে, এই ঘটনা সমাজের বিভিন্ন স্তরে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এটি শুধু একটি অপরাধের ঘটনা নয়, বরং সমাজের গভীরে থাকা কিছু সমস্যার প্রতিফলন। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজকে এগিয়ে যেতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।