গরমে জীবনদায়ী ডাবের জল: প্রতিদিন কতটুকু পান করলে মিলবে সর্বোচ্চ উপকার?

Coconut water benefits in summer : গরমকালে প্রচণ্ড তাপে শরীর অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং ডিহাইড্রেশন একটি সাধারণ সমস্যা। এমন সময়ে ডাবের জল একটি দারুণ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু…

Debolina Roy

 

Coconut water benefits in summer : গরমকালে প্রচণ্ড তাপে শরীর অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং ডিহাইড্রেশন একটি সাধারণ সমস্যা। এমন সময়ে ডাবের জল একটি দারুণ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, প্রতিদিন কতটুকু ডাবের জল পান করা উচিত? পুষ্টিবিদ মীনাক্ষী মজুমদারের মতে, “একজন সুস্থ-সবল ব্যক্তি প্রতিদিন একটা করে ডাবের জল খেতে পারেন। তাতে উপকার পাবেন। শরীর থাকবে সুস্থ।” কিন্তু এর থেকে বেশি খাওয়া আবার হিতে বিপরীত হতে পারে। আসুন জেনে নেই, কেন এবং কতটুকু ডাবের জল পান করা উচিত।

ডাবের জল: প্রাকৃতিক পরশমণি

ডাবের জল যুগ যুগ ধরে প্রাচ্যের পরশমণি হিসেবে পরিচিত এবং বিশ্বের অনেক দেশে এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। কোস্টারিকা, ডমিনিকান রিপাবলিক, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, ফিলিপিনস, ব্রাজিল, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মেক্সিকো এবং ভারতবর্ষে এটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন নারকেল উৎপাদিত হয়। ইন্দোনেশিয়াতে সবচেয়ে বেশি নারকেল উৎপাদিত হয়, তারপর আসে ফিলিপিনস এবং ভারতবর্ষ। ভারতে কেরালা, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুতে সবচেয়ে বেশি নারকেল চাষ হয়।

Coconut Water: পুষ্টিগুণে ভরপুর

ডাবের জল প্রায় ৯৫% শুধু জল। এর ক্যালরি মান অত্যন্ত কম, এবং এর জল পানে দেহে চর্বি বৃদ্ধি হয় না। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং ইলেক্ট্রোলাইট থাকে যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এছাড়াও এতে আছে ভিটামিন সি, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম।

এক কাপ (২৪০ মিলিলিটার) ডাবের জলে ৫০৯ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে, যা দৈনিক প্রয়োজনীয় পরিমাণের ১৫%। এই পটাশিয়াম মাংসপেশির কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য এবং ব্যায়ামের সময় মাংসপেশির খিঁচুনি কমাতে সাহায্য করে।

ডাবের জলের উপকারিতা

১) হার্ট ভাল রাখে

নিয়মিত ডাবের জল পান করলে শরীরের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে। রক্তচাপও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কম থাকে। ডাবের জলে থাকা উচ্চ পটাশিয়াম দেহে সোডিয়ামের মাত্রা সন্তুলিত রাখে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

২) হজমশক্তি বাড়ায়

ডাবের জল শরীরে পিএইচ স্তরের ভারসাম্য বজায় রাখে, যার ফলে গ্যাস-অম্বলের সম্ভাবনা কমে6। এতে ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকায় হজমেও সাহায্য করে।

৩) ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়

নিয়মিত ডাবের জল পান করলে ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে। বলিরেখা ও দাগছোপ দূর করতে সাহায্য করে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে এবং সতেজ রাখে।

৪) ওজন কমানো

ওজন কমাতে চাইলে নরম পানীয়, বেশি চিনি দেওয়া প্যাকেটবন্দি ফলের রস না খেয়ে ডাবের জল পান করা উত্তম। এটি কম ক্যালোরি সম্পন্ন (১ কাপে মাত্র ৬০ ক্যালোরি) এবং প্রায় চর্বিমুক্ত।

৫) শরীর ঠান্ডা রাখে

গরমে ডাবের জল শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখে। ইলেক্ট্রোলাইটের তারতম্য হতে দেয় না। মাথা ঘোরা, গা গোলানো ভাব দূর করতে সাহায্য করে।

৬) রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ

ডাবের জলে অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, যা ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে।

প্রতিদিন কতটুকু ডাবের জল পান করা উচিত?

পুষ্টিবিদ মীনাক্ষী মজুমদারের পরামর্শ অনুসারে, “একজন সুস্থ-সবল ব্যক্তি প্রতিদিন একটা করে ডাবের জল খেতে পারেন। তাতে উপকার পাবেন। শরীর থাকবে সুস্থ। এড়িয়ে চলা যাবে একাধিক জটিল অসুখ।” এর থেকে বেশি পান করা উচিত নয়, কারণ এতে বেশ কিছু খনিজ রয়েছে যা শরীরে বেশি পরিমাণে পৌঁছে গেলে বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি টক্সিসিটির সমস্যা হতে পারে।

আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতেও, দৈনিক ১-২ কাপ (৮ আউন্স বা ২৪০ মিলিলিটার) ডাবের জল পান করা যেতে পারে। অনেকে নিয়মিত এটি পান করেন, আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র ব্যায়ামের পরে স্পোর্টস ড্রিংকের বিকল্প হিসেবে পান করেন।

ডাবের জল পানের সেরা সময়

সকালে খালি পেটে

ডাবের জল সবচেয়ে বেশি উপকারী হয় যখন এটি সকালে খালি পেটে পান করা হয়। ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার আগেই এই পানীয় খেয়ে নেওয়া ভাল। ডাবের জলে রয়েছে লরিক অ্যাসিড, যা নানা ধরনের রোগের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।

ওয়ার্কআউটের আগে ও পরে

শরীরচর্চার আগে কিংবা পরে ডাবের জল পান করতে পারেন। এতে শরীর সতেজ থাকে এবং ব্যায়ামের সময় হারানো ইলেক্ট্রোলাইট পুনরায় পূরণ হয়।

সন্ধ্যাবেলা

সারা দিনের কাজকর্মের পর সন্ধ্যায় এক কাপ ডাবের জল পান করলে ক্লান্তি দূর হয়। এটি শরীরকে রিফ্রেশ করে এবং হাঁটাচলার সময়ও পান করা যেতে পারে।

যাদের ডাবের জল এড়িয়ে চলা উচিত

কিডনির রোগীদের সাবধানতা

ক্রনিক কিডনির অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডাবের জল থেকে দূরে থাকা উচিত। পুষ্টিবিদ মীনাক্ষী মজুমদারের মতে, “আজকাল ডায়াবিটিস ও হাই ব্লাড প্রেশারের মতো অসুখের জন্য অনেকেই ক্রনিক কিডনির অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর এই অসুখ হলে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার এবং পানীয় এড়িয়ে চলা জরুরি। দুর্ভাগ্যক্রমে ডাবের জলে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে। তাই ক্রনিক কিডনির অসুখ থাকলে কোনও ভাবেই ডাবের জল খাওয়া চলবে না।”

ডায়াবেটিস রোগীদের সতর্কতা

যদিও ডাবের জল রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে, তবুও ডায়াবেটিসের রোগীদের কতটুকু ডাবের জল পান করা উচিত, সেটা চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের থেকে জেনে নেওয়া উচিত।

ডাবের জল সম্পর্কে কিছু চিত্তাকর্ষক তথ্য

ডাবের জল শুধু একটি তৃষ্ণা নিবারক পানীয়ই নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পুষ্টির ভাণ্ডার। এর স্বাদ নির্ভর করে যে মাটিতে গাছটি চাষ করা হয় তার গুণমানের উপর1। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় উৎপাদিত নারকেলের জলের গন্ধ হালকা নোনতা হতে পারে।

গর্ভবতী মহিলাদের জন্যও ডাবের জল উপকারী। এটি মর্নিং সিকনেসের সময় হারিয়ে যাওয়া পুষ্টি উপাদান পুনরায় পূরণ করতে সাহায্য করে।

এছাড়া, ডাবের জলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা শরীরের কোষগুলিকে ফ্রি র‍্যাডিক্যালস থেকে রক্ষা করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।

ডাবের জল একটি চমৎকার প্রাকৃতিক পানীয় যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করে। তবে সব কিছুর মতোই, এটি মাত্রা মেনে পান করা উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, একজন সুস্থ ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন একটি ডাবের জল পান করাই যথেষ্ট। এর বেশি পান করলে পটাশিয়াম ও অন্যান্য খনিজের অতিরিক্ত জমা হতে পারে।

সকালে খালি পেটে, ব্যায়ামের আগে বা পরে, অথবা সন্ধ্যাবেলা এই প্রাকৃতিক পানীয় পান করে সর্বাধিক উপকার পাওয়া যায়। তবে কিডনি রোগীদের এই পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত।এই গরমে শরীরকে সতেজ ও হাইড্রেটেড রাখতে ডাবের জল অবশ্যই পান করুন, কিন্তু মাত্রা মেনে—প্রতিদিন একটি ডাবের জলই যথেষ্ট।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।