ভারতকে একসময় বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের অনন্য উদাহরণ হিসেবে দেখা হত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশের এই ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ক্রমশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। একদিকে সংবিধানে সুরক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় উগ্রবাদ – এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারার মধ্যে ভারতের ভবিষ্যৎ যে কোন পথে এগিয়ে চলেছে, তা নিয়ে দেশব্যাপী উদ্বেগ বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, সেক্যুলারিজম বনাম ধর্মান্ধতার এই সংঘর্ষ ভারতীয় সমাজের মূল চেতনাকে প্রভাবিত করছে।
ভারতীয় সংবিধানে সেক্যুলারিজমের ধারণা
ভারতীয় সংবিধানে সেক্যুলারিজম একটি মৌলিক নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই নীতি ধর্ম থেকে একটি নীতিগত দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নিপুণ মিথস্ক্রিয়ার অনুমতি দেয়। প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি “সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে প্রস্তাবনায় “ধর্মনিরপেক্ষ” শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করা হয়, যা সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষতা বজায় রাখার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারকে শক্তিশালী করে।
ভারতীয় সেক্যুলারিজমের মূল বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা পাশ্চাত্য ধারণা থেকে কিছুটা ভিন্ন। এই মডেলের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
- বৈষম্যহীনতা: রাষ্ট্রকে সমস্ত ধর্মকে সমানভাবে বিবেচনা করতে হয় এবং কোনো একটি ধর্মকে অন্যের উপরে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না।
- ধর্মীয় স্বাধীনতা: নাগরিকদের নিজেদের ধর্ম পালন, প্রচার ও অনুসরণ করার অধিকার রয়েছে।
- সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি: সংবিধান এমন ধর্মীয় আচরণে হস্তক্ষেপের অনুমতি দেয় যা সামাজিকভাবে অন্যায়পূর্ণ বলে মনে করা হয়, যেমন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আইন এবং ব্যক্তিগত আইনে লিঙ্গ সমতার জন্য বিধান।
সুপ্রিম কোর্ট এই নীতিগুলি ব্যাখ্যা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ বনাম গুজরাট রাজ্য (AIR 1974 SC 1389 at 1414) মামলায় আদালত নিশ্চিত করেছে যে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মবিরোধিতার সমার্থক নয়; বরং এতে নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদীদের অধিকারও অন্তর্ভুক্ত।
এসআর বোম্মাই বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া (AIR 1994 SC 1918) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে যে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্র সব ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সমানভাবে বিবেচনা করে। ধর্ম বিশ্বাসের বিষয় এবং এটি সেকুলার কার্যকলাপের সাথে মিশ্রিত করা যাবে না। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র সেকুলার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ভারতে সেক্যুলারিজমের বিভিন্ন মাত্রা
ভারতীয় সমাজে সেক্যুলারিজম কেবল রাজনৈতিক ধারণা নয়, বরং এর বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে যা সামাজিক কাঠামোর গভীরে প্রোথিত:
সামাজিক মাত্রা:
ধর্মনিরপেক্ষতা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করে সামাজিক সম্প্রীতি প্রচার করে। এটি ধর্মের ভিত্তিতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
রাজনৈতিক মাত্রা:
সেক্যুলারিজম নিশ্চিত করে যে কোনো একক ধর্মীয় গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতা একচেটিয়া করে না, যার ফলে গণতান্ত্রিক নীতিগুলি সংরক্ষিত হয়।
অর্থনৈতিক মাত্রা:
সমতা ও ন্যায়বিচারের উপর জোর দিয়ে, সেক্যুলারিজম ধর্মের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করে, সকলের জন্য ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করে।
সাংস্কৃতিক মাত্রা:
ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রচার করে।
শিক্ষাগত মাত্রা:
শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে সম্মান করার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক মেজাজ ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা গড়ে তোলার লক্ষ্য রাখে।
বর্তমান ভারতে ধর্মান্ধতার উত্থান
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে সংবিধান ও ধর্মীয় স্বাধীনতার আড়ালে দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ছে।
আহমেদাবাদে RSS-এর শীর্ষ সংস্থা ‘প্রতিনিধি সভা’র বার্ষিক তিন দিনের বৈঠকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “দেশে বাড়তে থাকা বিভাজনকারী উপাদানগুলির চ্যালেঞ্জও উদ্বেগজনক। আদমশুমারির বছর যত এগিয়ে আসছে, এমন উদাহরণ রয়েছে যেখানে একটি গোষ্ঠীকে এই বলে উসকানি দেওয়া হচ্ছে যে ‘তারা হিন্দু নয়’।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, “হিন্দু সমাজে বিভিন্ন বিভাজনকারী প্রবণতা বাড়িয়ে সমাজকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা চলছে।” ধর্মীয় উগ্রবাদকে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে, প্রতিবেদনে হিজাব বিতর্কের সময় কর্ণাটকে এবং কেরালায় হিন্দু সংগঠনের কর্মীদের সাম্প্রতিক হত্যার ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতে সেক্যুলারিজমের সামনে চ্যালেঞ্জ
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর সামনে বেশ কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
সাম্প্রদায়িকতা:
ধর্মীয় মেরুকরণ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে দুর্বল করেছে। দেশবিভাগ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, এবং নিয়মিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ঘটনাগুলি ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার চ্যালেঞ্জগুলি তুলে ধরে।
ধর্মের রাজনীতিকরণ:
রাজনৈতিক দল ও নেতারা প্রায়ই ভোট পাওয়ার জন্য ধর্মীয় অনুভূতিগুলিকে কাজে লাগান, যা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ধর্মীয় মৌলবাদ:
বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে চরমপন্থী মতাদর্শের উত্থান ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিচারিক ব্যাখ্যা:
ধর্মীয় বিষয়ে আদালতের রায় কখনও কখনও বিতর্ক সৃষ্টি করে, যা ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
সর্বজনীন নাগরিক বিধি (ইউসিসি):
একটি ইউসিসি বাস্তবায়ন একটি বিতর্কিত বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে, কেউ কেউ যুক্তি দেন যে এটি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে অন্যরা এটিকে ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখেন।
জাত ও ধর্মীয় বৈষম্য:
জাতি-ভিত্তিক বৈষম্য ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারাকে চ্যালেঞ্জ করে চলেছে।
ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার উদাহরণ
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং একসময় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে পরিচিত ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। একজন প্রধান হিন্দু নেতা খ্রিস্টান গির্জায় আক্রমণের প্রশংসা করে বলেছেন, এগুলি উপাসনার স্থান নয়, বরং “হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরের কারখানা।” তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে যারা এই ধরনের আক্রমণ চালায় তাদের রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতীয় ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স (সিবিসিআই) এই মন্তব্য়কে অত্যন্ত উসকানিমূলক ও দায়িত্বহীন বলে কঠোরভাবে নিন্দা করেছে এবং খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার উপর আলোকপাত করেছে।
২০১৪ সালের মধ্য থেকে যখন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তখন থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্রমশ আক্রমণের শিকার বোধ করছেন। বিজেপি এবং তার স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রচার করে।
ভারতে খ্রিস্টানদের বাড়িতে গ্রুপ প্রার্থনায় অংশ নেওয়ার জন্য এবং খ্রিস্টান বিবাহ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছু খ্রিস্টানকে তাদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে হিন্দুধর্মে “পুনরায় ধর্মান্তর” করতে বাধ্য করা হয়েছে। ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে কমপক্ষে ১২টি রাজ্য হিন্দুদের অন্য ধর্মে ধর্মান্তরকে অপরাধ ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন করেছে।
ভারতে ধর্মীয় সম্প্রীতির ভবিষ্যৎ
স্বাধীন ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সক্রিয়ভাবে ধর্ম ও ধর্মীয় বিষয় সংক্রান্ত বিবাদের বিচার করে আসছে। বিচারব্যবস্থা বিভিন্ন ঐতিহাসিক মামলায় সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রেখেছে।
কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩) মামলায়, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিল। এই মামলায়, প্রধান বিচারপতি সিকরি বলেছিলেন যে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতি ছিল এর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
এসআর বোম্মাই বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া (১৯৯৪) মামলায়, সর্বোচ্চ আদালত ভারতীয় সংবিধানের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিকতা নিশ্চিত করেছিল। আদালত অনুসারে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সব ধর্মকে একই সম্মান দেওয়া এবং রাষ্ট্রকে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। এটাও বলা হয়েছে যে ধর্ম ও রাজনীতি মেশানো উচিত নয়।
ভারতের ভবিষ্যৎ সেক্যুলারিজম এবং ধর্মান্ধতার মধ্যে একটি জটিল ভারসাম্যে ঝুলছে। বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে, এই ভারসাম্য ক্রমশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো বজায় রাখতে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ থেকে মুক্ত থাকতে নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বিচার বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
ভারতের সাংবিধানিক মূল্যবোধ, যা সকল ধর্মকে সমান সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়, তার প্রতি পুনঃপ্রতিশ্রুতি আবশ্যক। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল একটি রাজনৈতিক আদর্শ নয়, বরং ভারতের বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামাজিক ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রচার, এবং সংবিধানের মূল নীতিগুলির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এমন একটি ভারত গড়তে সাহায্য করবে যেখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য সম্ভব।
ভারতের ভবিষ্যৎ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মান্ধতার মধ্যে যে পথ অনুসরণ করবে, তা শুধু দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণই করবে না, বরং ভারতের বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতাও নির্ধারণ করবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ নাগরিকদের দায়িত্ব হল সংবিধানের মূল মূল্যবোধ বজায় রাখা এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ ও সমৃদ্ধ ভারত নিশ্চিত করা যায়।