Contribution of Jyoti Bose in West Bengal Politics: বাংলার রাজনীতির আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র – জ্যোতি বসু। তাঁর নাম শুনলেই মনে ভেসে ওঠে একজন দৃঢ়চেতা, নীতিনিষ্ঠ এবং জনপ্রিয় নেতার ছবি। কিন্তু কীভাবে এই ব্যারিস্টার থেকে কমিউনিস্ট নেতা হয়ে উঠলেন বাংলার সর্বকালের সেরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব? আসুন জেনে নেই সেই অনন্য জীবনকাহিনী, যা আজও প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
জ্যোতি বসুর জন্ম ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতা নীরদ বিহারী বসু ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। ছোটবেলা থেকেই জ্যোতি বসু মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ১৯৩৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান।
লন্ডনে থাকাকালীন সময়েই জ্যোতি বসুর জীবনে আসে এক বড় মোড়। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের সংস্পর্শে আসেন এবং গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এই সময় থেকেই তাঁর মধ্যে গড়ে ওঠে বামপন্থী চিন্তাধারা, যা পরবর্তীতে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।
১৯৪০ সালে স্বদেশে ফিরে জ্যোতি বসু সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সময় থেকেই তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত হন।
১৯৪৬ সালে জ্যোতি বসু প্রথমবারের মতো বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি ক্রমাগত ১১ বার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হন, যা একটি অনন্য রেকর্ড। ১৯৫৭ সালে তিনি বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে জ্যোতি বসু সিপিআই(এম)-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এই সময় থেকেই তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে টানা ২৩ বছর তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, যা ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সময়কাল।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসুর শাসনকাল ছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যুগ। তিনি পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যা গ্রামীণ উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করে। তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। অপারেশন বর্গার মাধ্যমে ভূমিসংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়, যা কৃষকদের জীবনমানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জ্যোতি বসুর শাসনকালে শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। হলদিয়া শিল্পাঞ্চল, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি গড়ে ওঠে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় জ্যোতি বসুর অবদান ছিল অনন্য। তিনি সব সময় ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় ঐক্যের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। দেশের রাজনীতিতেও তাঁর প্রভাব ছিল অপরিসীম। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদ প্রত্যাখ্যান করেন, যা তাঁর নীতিনিষ্ঠার প্রমাণ।
২০০০ সালের ৬ নভেম্বর জ্যোতি বসু স্বেচ্ছায় মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপরও তিনি দলের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যান। ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি এই মহান নেতার জীবনাবসান ঘটে।
জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবন ছিল বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য। তিনি ছিলেন একাধারে দক্ষ প্রশাসক, কুশলী রাজনীতিবিদ এবং জনপ্রিয় নেতা। তাঁর সততা, নীতিনিষ্ঠা ও দূরদর্শিতা তাঁকে অন্যান্য নেতাদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার দেশের সামনে একটি বিকল্প উন্নয়ন মডেল তুলে ধরেছিল। কৃষি ও শিল্পের সমন্বিত উন্নয়ন, বিকেন্দ্রীকরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের নীতি ছিল অনুকরণীয়।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল সাদাসিধে ও নির্লোভ। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনও তিনি সরকারি বাসভবনে থাকতেন না, নিজের বাড়িতেই বসবাস করতেন। তাঁর এই সরল জীবনযাত্রা তাঁকে জনগণের কাছে আরও প্রিয় করে তুলেছিল।
Office Politics Survival Guide: অফিস রাজনীতির শিকার? গোপন কৌশলে সব হবে কুপোকাত
জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে। তিনি মনে করতেন, সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই কারণেই তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন।
জ্যোতি বসু কবে থেকে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন
জ্যোতি বসু ১৯৪০ সালে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। তিনি লন্ডন থেকে আইন পড়ে ফিরে এসে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই)-এর সাথে যুক্ত হন এবং প্রথমে রেলওয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে লিপ্ত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি বেঙ্গল বিধানসভায় প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন এবং এরপর থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়
জ্যোতি বসু কোন পদক্ষেপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নে অবদান রাখেন
সমাপ্তি:
জ্যোতি বসুর জীবন ও কর্ম আজও নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সততা ও জনমুখী নীতি তাঁকে করে তুলেছে অমর। বাংলার রাজনীতিতে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলো আজও পথ দেখায় অসংখ্য মানুষকে। জ্যোতি বসুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের রাজনীতিবিদরা যদি দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করেন, তবেই সার্থক হবে এই মহান নেতার জীবনসংগ্রাম।