পশ্চিমবঙ্গের বহু প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলের কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যের নাট্যজগতে নেমে এসেছে বিপর্যয়। বহু বছর ধরে যে সমস্ত নাট্যদল কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানের সাহায্যে তাদের শিল্পচর্চা চালিয়ে আসছিল, তারা এখন অর্থসংকটে পড়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে শুধু নাট্যদলগুলিই নয়, বাংলার সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অনুদান বন্ধের কারণ ও প্রভাবিত নাট্যদল:
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও স্পষ্ট কারণ জানানো হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অনুদান বন্ধের তালিকায় রয়েছে মেঘনাদ ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘নান্দীকার’ এবং আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল। এই সিদ্ধান্তের ফলে শুধু কলকাতার নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের নাট্যজগৎ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
India’s Startup Ecosystem: ৫টি সরকারি প্রকল্প যা স্টার্টআপকে অন্যমাত্রায় রূপান্তরিত করছে
নাট্যকর্মীদের প্রতিক্রিয়া:
এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন রাজ্যের বিভিন্ন নাট্যকর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, এই সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। বাংলার নাট্যজগৎকে রাজনীতির শিকার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেকে মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আঘাত করবে।
পশ্চিমবঙ্গের নাট্যচর্চার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। বাংলা নাটক শুধু মনোরঞ্জনের মাধ্যম নয়, এটি সামাজিক পরিবর্তন ও জাগরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে আসছে। ‘নবজাগরণ’ শব্দটি উচ্চারণেই বাঙালির মনে জেগে ওঠে ইতিহাসের পাতা, যেখানে নাটক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, যা রাজ্য সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়, বাংলা নাট্যচর্চার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠান নাট্যগবেষণা ও নাট্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ হওয়ার ফলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলিও চাপের মুখে পড়তে পারে।
সরকারি কর্মচারীদের RSS-এ যোগদানের পথ খুলল মোদী সরকার: ৫৮ বছরের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল!
অর্থনৈতিক প্রভাব:
নাট্যদলগুলির জন্য কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ হওয়া শুধু সাংস্কৃতিক দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও একটি বড় আঘাত। অনেক নাট্যকর্মী ও শিল্পী এই অনুদানের উপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন তাঁদের সামনে আর্থিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৭০ জন দরিদ্র লোকশিল্পীকে মাসে ১৫০০ টাকা করে পেনশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ হওয়ার ফলে এই ধরনের উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
১. সাংস্কৃতিক ক্ষতি: বাংলা নাটকের ঐতিহ্য ও মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। নতুন প্রযোজনা ও গবেষণার কাজ ব্যাহত হতে পারে।
২. অর্থনৈতিক সংকট: অনেক নাট্যকর্মী ও শিল্পী তাদের জীবিকা হারাতে পারেন। নাট্যদলগুলি আর্থিক সংকটে পড়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৩. সামাজিক প্রভাব: নাটক যেহেতু সামাজিক পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম, তাই এর প্রভাব সমাজের বিভিন্ন স্তরে পড়তে পারে।
৪. শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রভাব: অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাট্যচর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনুদান বন্ধ হওয়ার ফলে এই ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
৫. পর্যটন শিল্পে প্রভাব: বাংলার নাট্যজগৎ পর্যটকদের আকর্ষণের একটি অন্যতম কেন্দ্র। এর ক্ষতি হলে পর্যটন শিল্পেও প্রভাব পড়তে পারে।
সমাধানের সন্ধানে:
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পক্ষ থেকে যা যা প্রস্তাব উঠে আসছে:
১. রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ: অনেকে মনে করছেন, রাজ্য সরকারকে এগিয়ে এসে নাট্যদলগুলিকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
২. বেসরকারি উদ্যোগ: কর্পোরেট সংস্থা ও ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রস্তাব উঠেছে।
৩. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলির সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
৪. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম: অনলাইন টিকিট বিক্রি ও স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
৫. গণসংযোগ: জনসাধারণের কাছে এই সমস্যা তুলে ধরে সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের নাট্যজগতের জন্য এটি একটি কঠিন সময়। কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ হওয়ার ফলে শুধু নাট্যদলগুলি নয়, সমগ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। বাংলার সমৃদ্ধ নাট্যঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। নাট্যজগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করার পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।