তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলি জেলায় জাতপাতের বিভাজনকে কেন্দ্র করে এক বছরে ২৪০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে সিপিআইএম একটি যুগান্তকারী ঘোষণা করেছে। সারাদেশের তাদের সব পার্টি অফিসে জাতিভিত্তিক বিবাহের ব্যবস্থা করা হবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তিরুনেলভেলিতে এক জাতিভিত্তিক বিবাহের জন্য তাদের পার্টি অফিস ভাঙচুরের পরিপ্রেক্ষিতে।
সিপিআইএম তামিলনাড়ু রাজ্য সম্পাদক পি শণ্মুগম জানিয়েছেন, গত জুনে তিরুনেলভেলিতে একটি জাতিভিত্তিক বিয়ের আয়োজন করার পর তাদের পার্টি অফিস ভাঙচুর হয়েছিল। ২৩ বছর বয়সী উদয় দক্ষয়নী, যিনি উচ্চবর্ণের সৈব পিল্লাই সম্প্রদায়ের এবং ২৮ বছর বয়সী মদন কুমার, যিনি নিম্নবর্ণের অরুন্ধতীয়ার সম্প্রদায়ের, তাদের মধ্যে এই বিয়ে হয়েছিল। কনের পরিবার এবং তাদের সাথে সম্পৃক্ত জাতীয় সংগঠনের লোকজন পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালায়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পি শণ্মুগম স্পষ্ট জানিয়েছেন, “তিরুনেলভেলিতে পাত্রীর বাড়ির লোকজন আমাদের পার্টি অফিস ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু তাতেও আমরা পিছিয়ে আসিনি। এই ঘটনার পরেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, গোটা রাজ্যে সব পার্টি অফিস এই ধরনের বিয়ের জন্য আমরা খুলে দেব। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে এটা করতেই হবে।”
তিরুনেলভেলির ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে সিপিআইএম নেতা উল্লেখ করেছেন যে, শুধুমাত্র তিরুনেলভেলি জেলায় এক বছরে ২৪০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৫টি প্রতিশোধমূলক হত্যা এবং ১৬টি জাতিভিত্তিক হত্যা রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, “খুনিদের উদযাপন করার একটি বিপজ্জনক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।”
অতীতে তামিলনাড়ুর দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলো, বিশেষ করে তিরুনেলভেলি, তুতুকুড়ি এবং মাদুরাই জেলায় জাতিভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা প্রায়শই ঘটতে দেখা যায়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে তিরুনেলভেলি জেলায় জাতিভিত্তিক সহিংসতার শিকার ১,০৯৫ জন তফসিলি জাতির মানুষকে ১১.৩০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
জাতিভিত্তিক বিবাহের ক্ষেত্রে রাজ্যে বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকার কারণেই সিপিআইএম এই উদ্যোগ নিয়েছে। শণ্মুগম স্পষ্ট করেছেন যে তামিলনাড়ুতে জাতিভিত্তিক এবং স্ব-সম্মানজনক বিবাহ নিবন্ধন বা সহায়তার জন্য কোনো নির্দিষ্ট রাজ্যীয় ব্যবস্থা নেই।
গত জুনে তিরুনেলভেলিতে যে ঘটনা ঘটেছিল, তা জাতিভিত্তিক বিবাহের বিরুদ্ধে সমাজের একটি অংশের মানসিকতা প্রকাশ করে। মদন কুমার এবং উদয় দক্ষয়নী ছয় বছর ধরে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন। তারা ১২ জুন তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ১৩ জুনে সিপিআইএম পার্টি অফিসে আশ্রয় নেন। পার্টি তাদের স্ব-সম্মানজনক বিবাহের ব্যবস্থা করে দেয়।
কিন্তু ১৪ জুনে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। কনের পরিবার এবং ভেল্লালার মুন্নেত্রা কাঝগম নামক জাতীয় সংগঠনের ২৫ জন সদস্য পার্টি অফিসে হামলা চালায়। তারা অফিসের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে এবং দুজন পার্টি কর্মীকে আক্রমণ করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে কনের বাবা-মাসহ ১৬ জনকে গ্রেফতার করে।
এই ঘটনার পর থেকে দম্পতি লুকিয়ে রয়েছেন এবং তাদের বিবাহ নিবন্ধন করতে পারেননি। পার্টি নেতারা অভিযোগ করেছেন যে পুলিশ বিভাগের কিছু সদস্য এই তথ্য কনের পরিবার এবং জাতীয় সংগঠনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
জাতিভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশেষ আইনের দাবি জোরদার হয়েছে গত জুলাইয়ে ২৭ বছর বয়সী দলিত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কাভিন সেলভাগানেশের নৃশংস হত্যার পর। তিনি তেভার সম্প্রদায়ের এক নারীকে ভালোবাসার কারণে খুন হন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিসিকে সভাপতি থোল তিরুমাভালাভান, সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক পি শণ্মুগম এবং সিপিআই রাজ্য সম্পাদক আর মুথারাসন একযোগে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের কাছে একটি যৌথ আবেদন জমা দেন।
তাদের আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বিদ্যমান ফৌজদারি আইন জাতিভিত্তিক সম্মান হত্যা প্রতিরোধে অপর্যাপ্ত। তারা জানিয়েছেন যে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের দ্বারা সংঘটিত হয় না, বরং সামাজিক চাপ, প্রভাবশালী জাতির হুমকি এবং জাতি পবিত্রতার ভ্রান্ত ধারণার কারণে ঘটে।
তামিলনাড়ুতে জাতি ভিত্তিক সহিংসতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ১৯৯৫ সালে কোডিয়ঙ্কুলাম হিংসা, ১৯৯৭ সালে মেলাভালাভু গণহত্যা এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন জেলায় ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা এই সমস্যার গভীরতা প্রমাণ করে।
রাইট টু ইনফরমেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তামিলনাড়ুতে বিভিন্ন জাতিভিত্তিক সহিংসতায় মোট ৩০০টি খুনের ঘটনা নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ শিকার ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও জাতিভিত্তিক বিভাজন প্রভাব ফেলছে। তিরুনেলভেলির স্কুল-কলেজেও জাতিভিত্তিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে যে ২০২৪ সালে জাতিভিত্তিক উত্তেজনা প্রবণ গ্রামে ১৩,৯১৪টি টহল পরিচালনা করা হয়েছে এবং ৯৪টি স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে।
সিপিআইএম-এর এই ঘোষণা তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দলটির রাজ্য সম্পাদক পি শণ্মুগম, যিনি সম্প্রতি দলের প্রথম দলিত রাজ্য সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, জোর দিয়ে বলেছেন যে তারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবেন।
রাজ্যের অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। কংগ্রেসের তামিলনাড়ু তফসিলি জাতি শাখার নেতারা জানিয়েছেন যে তারা বিশ্বাস করেন ডিএমকে সরকার শীঘ্রই জাতিভিত্তিক হত্যার বিরুদ্ধে বিশেষ আইন প্রণয়ন করবে।
বর্তমানে জাতিভিত্তিক হত্যাকাণ্ড সাধারণ খুনের মামলা হিসেবে আইপিসি ৩০২ ধারা বা ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ১০১ ধারায় নিবন্ধিত হয়। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা যুক্তি দেন যে এই ধরনের খুনের পেছনে যে সামাজিক চাপ এবং জাতিভিত্তিক উদ্দেশ্য কাজ করে, সেটা সাধারণ খুনের মামলায় প্রকাশ পায় না।
মাদ্রাজ হাইকোর্ট ২০১৬ সালে বি দিলীপকুমার বনাম রাজ্য সরকার মামলায় জাতিভিত্তিক হত্যা রোধে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। আদালত প্রতিটি জেলায় বিশেষ সেল গঠন, ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন এবং জাতিভিত্তিক বিয়ের বিরোধিতাকারী অভিভাবকদের পরামর্শ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু প্রায় এক দশক পরেও এই নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, তামিলনাড়ুতে জাতিভিত্তিক সহিংসতার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শুধুমাত্র একটি সম্মান হত্যার মামলা নিবন্ধিত হয়েছে, কিন্তু গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৪০০টি এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন যে তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় আন্দোলন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হলেও গভীর শেকড়ের জাতিভিত্তিক সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। পেরিয়ারের অব্রাহ্মণ আন্দোলন পিছিয়ে পড়া জাতিগুলোকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করলেও সামাজিক কাঠামোয় জাতিভিত্তিক বিভাজন এখনো বিদ্যমান।
সিপিআইএম-এর এই ঘোষণা একটি প্রতীকী গুরুত্ব বহন করে। তবে বাস্তবে এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংস্থা এর পাশে দাঁড়াবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। জাতিভিত্তিক সহিংসতা রোধে শুধু রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ নয়, সমাজের সকল স্তরের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন এবং আইনি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।