পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসছে সিপিএম। দলের নতুন প্রজন্মের কর্মীদের উৎসাহিত করতে এবং সাধারণ মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘মিশন ৩৬০’ নামে একটি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বামফ্রন্টের এই শীর্ষ দল। ২০২৫ সালের প্রথম সাংগঠনিক বার্তায় দলের কর্মীদের কাছে এই নতুন দিকনির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই CPIM MISSION 360-এর বিস্তারিত রূপরেখা এবং লক্ষ্য কী।

CPIM MISSION 360: নতুন উদ্যোগের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা

২০২৫ সালের প্রথম ‘পার্টি চিঠি’ নামক সাংগঠনিক বার্তায় সিপিএম তাদের কর্মীদের কাছে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। ‘মিশন ৩৬০’ নামের এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিটি জেলায় অন্তত দু’টি বিকল্প পাঠদান কেন্দ্র এবং প্রতিটি এরিয়া কমিটিতে একটি করে স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই সামাজিক উদ্যোগগুলির মাধ্যমে রাজ্যের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং একই সঙ্গে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছানোই এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য।

CPIM MISSION 360 দলের কর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা এনেছে। দলীয় বার্তায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “বর্তমানে বিকল্প গড়ে তোলার লড়াই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।” এই বার্তা দলের ভিতরে এবং বাইরে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: CPIM MISSION 360-এর দু’টি মূল স্তম্ভ

সিপিএমের এই নতুন উদ্যোগে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য – এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলি সমাধানের দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে।

বিকল্প পাঠদান কেন্দ্র: শিক্ষায় নতুন দিগন্ত

প্রতিটি জেলায় অন্তত দুটি বিকল্প পাঠদান কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলিতে ছাত্র-যুব ফ্রন্ট, শিক্ষক, অধ্যাপক ও উচ্চশিক্ষায় পাঠরত ছাত্রদের যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে দল। এইসব কেন্দ্রের মাধ্যমে যে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে মূলধারার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তাদের শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।

CPIM MISSION 360-এর অধীনে এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন দক্ষতা বিকাশেও সাহায্য করবে এইসব কেন্দ্র। এর মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করা হবে।

স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র: স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার উদ্যোগ

প্রতিটি এরিয়া কমিটিতে একটি করে স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছে সিপিএম। এই কেন্দ্রগুলিতে কম খরচে চিকিৎসা পরামর্শ ও ওষুধ পাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। স্থানীয় চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, রেড ভলান্টিয়ার, ছাত্র-যুব সংগঠনের কর্মী এবং অন্যান্য সংগঠনগুলিকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

CPIM MISSION 360-এর আওতায় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার রাস্তা সহজ করবে। বিশেষ করে যেখানে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল, সেখানে এই উদ্যোগ একটি বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে।

CPIM MISSION 360: ২০২৬ সালের নির্বাচনী কৌশলের অংশ

CPIM MISSION 360 শুধু একটি সামাজিক উদ্যোগই নয়, এটি দলের ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনী কৌশলেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দল স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে যে “২০২৬ সালের নির্বাচন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রাম।” এই লক্ষ্যে রাজ্যের প্রতিটি বুথে স্থায়ী সংগঠন ও সদস্য গঠনের কাজ জুন ৩০-এর মধ্যে সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সিপিএম-এর শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছেন যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে জনসমর্থন পাওয়া যাবে না। তাই মিশন ৩৬০-এর মাধ্যমে তারা সরাসরি জনকল্যাণমূলক কাজের সাথে যুক্ত হতে চান। দলের একজন শীর্ষ নেতা স্পষ্টতই বলেছেন, “আমরা ভোটের হারই হারাইনি, মানুষের আস্থাও হারিয়েছি। সেই আস্থা ফেরাতে পারলেই ভোট আপনা থেকেই ফিরবে।”

CPIM MISSION 360-এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া

এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সিপিএম একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রথম পর্যায়ে, আগস্টের মধ্যে প্রতিটি জেলা থেকে এই কাজগুলির অগ্রগতি রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় দলের সামগ্রিক কর্মসূচি প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যদিও ব্যক্তিগত প্রচার এবং দলের সিদ্ধান্তবিরোধী মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

CPIM MISSION 360-এর বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবেন দলের জেলা ও স্থানীয় কমিটির সদস্যরা। তবে এই প্রক্রিয়ায় কতটা যোগ্য প্রার্থীদের কাজে লাগানো হবে, না কি স্থানীয় নেতৃত্বের ‘পছন্দের’ কিন্তু অকার্যকরীদের কাজে লাগানো হবে, সে বিষয়ে দলের অন্দরে প্রশ্ন রয়েছে। পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণেই মিলবে এর উত্তর।

বিকল্প শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র: একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ

CPIM MISSION 360-এর মতো উদ্যোগ বিশ্বের অন্যান্য অংশেও দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, টিমোর-লেস্তেতে স্কুল হেলথ রুম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং শিক্ষাগত সাফল্য বৃদ্ধির লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগে প্রয়োজনীয় ওষুধ, ওজন ও উচ্চতা পরিমাপের যন্ত্র এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে।

অন্য দিকে, অস্ট্রেলিয়াতে 360-কিডস কমিউনিটি নেটওয়ার্ক প্রোগ্রাম চালু হয়েছে, যার লক্ষ্য সকল শিশু ও যুবাদের সর্বোত্তম স্বাস্থ্য ও বিকাশের ভিত্তি প্রদান করা। বিশেষ করে প্রতিকূল অবস্থায় বসবাসকারী শিশুরা প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে, যা তাদের স্বাস্থ্য, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, স্কুল সংশ্লিষ্টতা এবং শিক্ষার সুযোগ উন্নত করতে পারে।

সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের মতামত

সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মোহম্মদ সেলিম মিশন ৩৬০ সম্পর্কে বলেন, “আমরা সরকারি স্বাস্থ্য বা শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা করছি না। কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলির দুর্বলতা থেকেই সাধারণ মানুষ বিপদে পড়ছেন। আমরা সেই ফাঁক পূরণ করে দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে চাই।”

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে CPIM MISSION 360 শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলি সমাধানের একটি প্রয়াসও বটে। তবে এই উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করবে এর বাস্তবায়নের উপর।

CPIM MISSION 360 এবং আরজিকর আন্দোলনের সম্পর্ক

সিপিএম নেতৃত্ব এটাও উল্লেখ করেছেন যে, “আরজিকর আন্দোলনের সময় অনেকেই আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। এবার সেই শক্তিকে ভবিষ্যতের আন্দোলনে কাজে লাগাতে হবে।” এই বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে দল আরজিকর আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে CPIM MISSION 360-এর মাধ্যমে জনসমর্থন বাড়াতে চাইছে।

আরজিকর আন্দোলনে যে জনসমাবেশ হয়েছিল, তার থেকে সিপিএম বুঝতে পেরেছে যে সাধারণ মানুষ এখনও তাদের সাথে আছে, শুধু তাদের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা প্রয়োজন।

CPIM MISSION 360: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

CPIM MISSION 360 যেমন সম্ভাবনাময়, তেমনি এর সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এই উদ্যোগের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে প্রকৃত বাস্তবায়নের উপর। সিপিএম-এর নেতৃত্বকে নিশ্চিত করতে হবে যে এই কর্মসূচি শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবে রূপায়িত হয়।

বিকল্প শিক্ষাকেন্দ্র ও স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্রগুলির জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ, পর্যাপ্ত সংস্থান সংগ্রহ এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসই পরিচালনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা – এই তিনটি বিষয়ই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

CPIM MISSION 360-এর ভবিষ্যৎ

CPIM MISSION 360 সিপিএম-এর একটি সাহসী পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে দল হারিয়ে যাওয়া জনসমর্থন ফিরে পেতে চাইছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য – এই দুটি মৌলিক অধিকারকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা এই উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটবে এবং সেই সঙ্গে দলের রাজনৈতিক সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে।

তবে শেষ পর্যন্ত, এই উদ্যোগের সাফল্য মূলত নির্ভর করবে এর বাস্তবায়নের উপর। এখন দেখার বিষয়, আগামী মাসগুলিতে CPIM MISSION 360 কতটা সফলভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনে এর প্রভাব কেমন হয়।