Current Situation West Bengal Mamata Banerjee Government: পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন উত্তাল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজ্যজুড়ে চলছে বিক্ষোভ। কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন মহিলা ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ এখন রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনরোষে পরিণত হয়েছে।
গত ৯ আগস্ট কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি রুমে একজন ২৫ বছর বয়সী মহিলা ডাক্তারকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর থেকেই রাজ্যজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। প্রথমে চিকিৎসক ও মেডিকেল ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করলেও পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। বিরোধী দলগুলিও এই সুযোগে সরব হয়ে ওঠে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে এই ঘটনাকে গুরুত্ব দিতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, পুলিশ দ্রুত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু বিক্ষোভ থামেনি। এরপর তিনি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলেও তা ব্যর্থ হয়। বরং তাঁর কিছু মন্তব্য উল্টো ফল দেয়। তিনি বলেছিলেন, “আমি বিক্ষোভের জন্য কোনো ব্যবস্থা নিইনি।” এই মন্তব্যকে অনেকেই হুমকি হিসেবে দেখেন। পরে তিনি অবশ্য বলেন যে তিনি ছাত্রদের পাশেই আছেন।
মমতার ‘ভুল’-এর মালা: R.G Kar কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর ৭টি বিতর্কিত মন্তব্য
কলকাতা হাইকোর্ট এই ঘটনার তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়। এছাড়া হাসপাতালে ভাঙচুর ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। এতে রাজ্য সরকারের বিব্রত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তৃণমূলের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বড় অংশই মহিলা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ২৯টি আসন পেয়েছিল, যার পিছনে মহিলা ভোটারদের বড় ভূমিকা ছিল। দলের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের মতো কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয়। কিন্তু এবার অনেক মহিলাই এই প্রকল্পের সুবিধা নিতে অস্বীকার করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের ২ কোটি ১৮ লক্ষ মহিলা সুবিধাভোগী রয়েছেন। এই প্রকল্পই তৃণমূলের জয়ের অন্যতম কারণ। কিন্তু এখন সেই মহিলারাই যদি বিমুখ হন, তাহলে দলের জন্য তা বিপদজনক হতে পারে।
বিজেপি এই সুযোগে তৃণমূলকে আক্রমণ করছে। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, “রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। মহিলারা নিরাপদ নন। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।”
অন্যদিকে, তৃণমূল নেতৃত্ব অভিযোগ করছেন, বিজেপি এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, “বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার অনেক বেশি। কিন্তু সেখানে কেউ প্রতিবাদ করে না।”
রাজ্য সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন আইন আনার চেষ্টা করছে। ৩ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় ‘অপরাজিতা উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড বিল (পশ্চিমবঙ্গ ক্রিমিনাল লজ অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২৪’ পাস করা হয়েছে। এই আইনে ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করা হয়েছে। যদি ধর্ষণের ফলে মৃত্যু হয় বা ভুক্তভোগী উদ্ভিদবৎ অবস্থায় চলে যান, তাহলে অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। গ্যাং রেপের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইনকে ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “এই আইন অন্য রাজ্যের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করবে। আমরা কেন্দ্রীয় আইনের ফাঁক গলা বন্ধ করার চেষ্টা করেছি।”
কিন্তু বিরোধীরা এই আইনকে যথেষ্ট মনে করছেন না। বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “শুধু আইন করলেই হবে না। সেটা কার্যকর করতে হবে। কিন্তু রাজ্য সরকারের সেই ইচ্ছাশক্তি নেই।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ২৯২টি আসনের মধ্যে ২১৩টিতে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু এবার সেই জয় ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।
নিম্নলিখিত টেবিলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল দেখানো হল:
দল | আসন সংখ্যা |
---|---|
তৃণমূল কংগ্রেস | ২৯ |
বিজেপি | ১২ |
কংগ্রেস | ১ |
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ফলাফল বদলে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মহিলা ভোটারদের মনোভাব পরিবর্তন হলে তা তৃণমূলের জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে।
রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। তিনি বলেছেন, “রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।”
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারও এই ইস্যুতে সরব হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু অভিযোগ করেছেন, রাজ্য সরকার কেন্দ্রের প্রস্তাবিত ফাস্ট ট্র্যাক স্পেশাল কোর্ট গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। তিনি বলেছেন, “২০১৮ সালে সংসদে কঠোর আইন পাস হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা কার্যকর করেনি।”
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন সংকটময় পর্যায়ে। তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা কমছে কি না, তা আগামী দিনগুলিতে স্পষ্ট হবে। তবে দলের নেতৃত্বকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।