কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) পাওয়ার দাবিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের করা মামলার শুনানি আরও একবার পিছিয়ে গেল দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্টে। রাজ্যের আইনজীবীরা অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় ব্যস্ত থাকায় এই শুনানি স্থগিত রাখার আবেদন জানানো হয়, যা আদালত মঞ্জুর করে। ফলে, ডিএ নিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য রাজ্য সরকারি কর্মী এবং পেনশনভোগীদের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হলো। এই ঘটনায় রাজ্যের লক্ষ লক্ষ কর্মচারী মহলে নতুন করে হতাশার সঞ্চার হয়েছে।
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি ঋষিকেশ রায় এবং বিচারপতি প্রশান্ত কুমার মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চে ডিএ মামলাটি শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত ছিল। কিন্তু দিনের শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইনজীবীরা শীর্ষ আদালতকে জানান যে, তাঁরা সন্দেশখালি সংক্রান্ত একটি মামলায় ব্যস্ত রয়েছেন, যা সেই মুহূর্তে অন্য বেঞ্চে চলছিল। রাজ্যের তরফে জানানো হয়, দুটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি একই দিনে পড়ায় তাদের পক্ষে ডিএ মামলায় সওয়াল-জবাবে অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে তারা শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনগুলোর আইনজীবীরা এর বিরোধিতা করলেও আদালত শেষ পর্যন্ত রাজ্যের আবেদন মঞ্জুর করে এবং শুনানি স্থগিত রাখে।
এই ঘটনা রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার লড়াইয়ে একটি নতুন সংযোজন মাত্র। মহার্ঘ ভাতার দাবিটি নতুন নয়। সর্বভারতীয় মূল্যসূচক অনুযায়ী, জীবনযাত্রার খরচ যে হারে বৃদ্ধি পায়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি কর্মীদের বেতন কাঠামো ঠিক রাখতে ডিএ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরা বর্তমানে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হারে ডিএ পাচ্ছেন। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্প্রতি ৪ শতাংশ ডিএ বৃদ্ধি করার পর রাজ্য কর্মীরা পাচ্ছেন মোট ১৪ শতাংশ। এই বিশাল ব্যবধানকে ‘বঞ্চনা’ হিসেবেই দেখছেন রাজ্যের কর্মীরা। তাঁদের দাবি, ডিএ কোনো দয়া বা অনুদান নয়, এটি তাদের আইনসঙ্গত অধিকার।
ডিএ নিয়ে এই আইনি লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট বেশ দীর্ঘ। রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলি প্রথমে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে (স্যাট) মামলা করে। দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের পর স্যাট কর্মীদের পক্ষে রায় দিয়ে জানায় যে, ডিএ কর্মীদের ন্যায্য অধিকার। কিন্তু রাজ্য সরকার স্যাটের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে যায়। কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চও স্যাটের রায় বহাল রাখে এবং ডিএ-কে কর্মীদের ‘আইনগত অধিকার’ বলে স্বীকৃতি দেয়। শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজ্যকে বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশও দেয় উচ্চ আদালত।
কলকাতা হাইকোর্টের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। এরপর থেকেই মামলাটি শীর্ষ আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু বারবার শুনানির তারিখ ধার্য হলেও বিভিন্ন কারণে তা পিছিয়ে গিয়েছে। কখনও রাজ্যের আইনজীবীরা সময় চেয়েছেন, কখনও আবার আদালতের কার্যতালিকা দীর্ঘ হওয়ায় শুনানি সম্ভব হয়নি। প্রতিটি তারিখের দিকেই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন রাজ্যের কয়েক লক্ষ কর্মচারী ও পেনশনভোগী। কিন্তু বারবার শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।
রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলির নেতাদের মতে, রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মামলাটি দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে। তাদের অভিযোগ, সরকার বকেয়া ডিএ দেওয়ার আর্থিক দায় এড়াতেই বারবার সময়ক্ষেপণের কৌশল নিচ্ছে। তাদের যুক্তি, যদি রাজ্যের আর্থিক অবস্থা এতটাই ভালো হয় যে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা যায়, তাহলে কর্মীদের ন্যায্য অধিকার মেটাতে অসুবিধা কোথায়? মূল্যবৃদ্ধির বাজারে নামমাত্র ডিএ দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে বলে তারা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, রাজ্য সরকারের যুক্তি হলো, তাদের উপর বিপুল আর্থিক বোঝা রয়েছে। কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথীর মতো একাধিক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালাতে সরকারের কোষাগার থেকে প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। সরকারের দাবি, এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ মেটানো হলে রাজ্যের আর্থিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। রাজ্য সরকার যে ধাপে ধাপে ডিএ বাড়াচ্ছে, তা তাদের সদিচ্ছারই প্রতিফলন বলে দাবি করা হয়েছে। তবে কর্মীদের দাবি, এই বৃদ্ধি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।
এদিনের শুনানিতে রাজ্য সরকারের আইনজীবী সন্দেশখালির মতো একটি সংবেদনশীল মামলায় ব্যস্ত থাকায় আদালত মানবিকতার খাতিরে সময় মঞ্জুর করেছে। তবে পরবর্তী শুনানির দিন এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সম্ভবত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হতে পারে বলে আদালত সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে। তবে চূড়ান্ত দিনক্ষণ পরেই জানা যাবে। আপাতত, ডিএ পাওয়ার আশায় বুক বাঁধা রাজ্যের লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মীকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এই আইনি লড়াইয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হবে, সেই উত্তর এখন ভবিষ্যতের গর্ভে।