Dark tourism in India: জানেন তো, বেড়াতে যাওয়া মানেই সবসময় সুন্দর পাহাড়, ঝর্ণা বা সমুদ্র নয়। কখনো কখনো মানুষ এমন কিছু জায়গায় যেতে চায়, যেখানে লুকিয়ে আছে কোনো মর্মান্তিক ইতিহাস, কোনো ভয়ঙ্কর স্মৃতি। এই অন্যরকম বেড়ানোর নামই হলো ডার্ক ট্যুরিজম।
ডার্ক ট্যুরিজম: একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা
১.১ ডার্ক ট্যুরিজম আসলে কী?
ডার্ক ট্যুরিজম (Dark Tourism) মানে হলো সেই সব জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, যেখানে কোনো খারাপ ঘটনা ঘটেছে, যেমন – যুদ্ধ, দুর্ঘটনা, বা অন্য কোনো মর্মান্তিক tragedy। এটা সাধারণ ট্যুরিজম (Tourism) থেকে একদম আলাদা। নরমাল ট্যুরিজমে মানুষ সুন্দর জায়গায় যায়, আনন্দ করে। কিন্তু ডার্ক ট্যুরিজমে মানুষ যায় সেই সব জায়গায়, যেখানে কষ্ট আর দুঃখের ইতিহাস লেখা আছে।
১৯৯৬ সালে জন লেনন (John Lennon) আর ম্যালকম ফোলি (Malcolm Foley) প্রথম এই ডার্ক ট্যুরিজম কনসেপ্টটা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, মানুষ কেন সেই সব জায়গায় যেতে চায়, যেখানে মৃত্যু আর ধ্বংসের চিহ্ন আছে।
ডার্ক ট্যুরিজমের কিছু বিশেষ দিক আছে:
- এখানে মৃত্যু আর শোকের একটা পরিবেশ থাকে।
- ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর সাক্ষী থাকা যায়।
- মানুষের কষ্টের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়।
- ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
ভারতের সেরা ১০টি হিন্দু উৎসব
১.২ ডার্ক ট্যুরিজমের প্রকারভেদ
ডার্ক ট্যুরিজম বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। নিচে কয়েকটা প্রধান ভাগ আলোচনা করা হলো:
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের জায়গা: যেসব জায়গায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural disaster) হয়েছে, যেমন – সুনামি, ভূমিকম্প, বা ঘূর্ণিঝড়, সেখানে অনেকে ঘুরতে যায়। জাপানের সুনামি বিধ্বস্ত এলাকা এর একটা উদাহরণ। মানুষ সেখানে গিয়ে দেখে, প্রকৃতির রুদ্র রূপ কিভাবে একটা এলাকাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
- মানুষের তৈরি করা দুর্যোগের জায়গা: যেখানে মানুষের ভুলের কারণে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই জায়গাগুলোও ডার্ক ট্যুরিজমের মধ্যে পড়ে। চেরনোবিলের ঘটনা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল nuclear power plant-এ explosion হওয়ার পর পুরো এলাকা জনমানবশূন্য হয়ে যায়। এখন অনেকে সেখানে যায় সেই ভয়াবহতা নিজের চোখে দেখতে।
- মানবতাবিরোধী অপরাধের জায়গা: যেসব জায়গায় মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে, যেমন – কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প (Concentration camp) বা গণহত্যার স্থান, সেগুলোও ডার্ক ট্যুরিজমের অংশ। পোল্যান্ডের অসউইচ (Auschwitz) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হলো এর একটা উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল।
১.৩ ডার্ক ট্যুরিজম কেন এত জনপ্রিয় হচ্ছে?
আজকাল ডার্ক ট্যুরিজম অনেক জনপ্রিয় হচ্ছে, বিশেষ করে GenZ-দের (Generation Z) মধ্যে। এর কিছু কারণ আছে:
- জানার আগ্রহ: GenZ ইতিহাস জানতে খুব আগ্রহী। তারা বই পড়ে, ডকুমেন্টারি দেখে, আর বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে চায়। ডার্ক ট্যুরিজম তাদের সেই সুযোগটা দেয়।
- আবেগপূর্ণ অভিজ্ঞতা: এই ধরনের জায়গায় গেলে মানুষের মনে গভীর emotion তৈরি হয়। তারা বুঝতে পারে, জীবনে অনেক কষ্ট আছে এবং সেই কষ্টগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হয়।
- সোশ্যাল মিডিয়া: আজকাল সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা Social Media-তে share করতে চায়। ডার্ক ট্যুরিজমের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের থেকে আলাদা, তাই GenZ-রা এই ধরনের জায়গায় গিয়ে ছবি তোলে এবং নিজেদের অনুভূতি share করে। এতে ডার্ক ট্যুরিজম আরও বেশি জনপ্রিয় হয়।
২. ভারতে ডার্ক ট্যুরিজম: GenZ-এর আগ্রহ
২.১ ভারতের কিছু জনপ্রিয় ডার্ক ট্যুরিজম স্পট
ভারতে অনেক ঐতিহাসিক জায়গা আছে, যেখানে ডার্ক ট্যুরিজমের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি মেমোরিয়াল: ১৯৮৪ সালে ভোপালে গ্যাস লিকেজের (Gas leakage) কারণে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। এই মেমোরিয়াল সেই tragedy-র (ট্র্যাজেডি) কথা মনে করিয়ে দেয়।
- জালিয়ানওয়ালাবাগ: ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ সৈন্যরা নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালিয়েছিল। এই জায়গাটি সেই নৃশংসতার সাক্ষী।
- আন্দামান সেলুলার জেল: ব্রিটিশ আমলে এই জেলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দী করে রাখা হতো এবং তাদের উপর অনেক অত্যাচার করা হতো।
এই জায়গাগুলো আমাদের দেশের ইতিহাসের অংশ এবং ডার্ক ট্যুরিজমের মাধ্যমে এই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
২.২ GenZ কেন ঝুঁকছে এই দিকে?
GenZ-রা কেন ডার্ক ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছে, তার কয়েকটা কারণ নিচে দেওয়া হলো:
- ইতিহাস জানার কৌতূহল: GenZ শুধু বইয়ের পাতায় ইতিহাস পড়তে চায় না, তারা সেই ইতিহাসকে অনুভব করতে চায়। ডার্ক ট্যুরিজম তাদের সেই সুযোগ দেয়।
- আবেগপূর্ণ অভিজ্ঞতা নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা: তারা এমন কিছু অভিজ্ঞতা নিতে চায়, যা তাদের মনে গভীর দাগ কাটে। ডার্ক ট্যুরিজম তাদের সেই ধরনের অভিজ্ঞতা দেয়।
- নতুন কিছু করার চেষ্টা: GenZ সবসময় নতুন কিছু করতে চায়। তারা গতানুগতিক বেড়ানোর থেকে আলাদা কিছু খুঁজে বেড়ায়। ডার্ক ট্যুরিজম তাদের জন্য একটা নতুন দিগন্ত।
- সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করার প্রবণতা: GenZ তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত Social Media-তে share করতে ভালোবাসে। ডার্ক ট্যুরিজমের অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার কারণে তারা এটা share করতে বেশি আগ্রহী হয়।
২.৩ কিছু কেস স্টাডি
অনেক GenZ-কে ভারতের ডার্ক ট্যুরিজম স্পটগুলোতে ঘুরতে দেখা যায়। তারা তাদের অভিজ্ঞতা Social Media-তে share করে। নিচে কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া হলো:
- কিছুদিন আগে কয়েকজন ব্লগার ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি মেমোরিয়ালে গিয়েছিলেন। তারা সেখানকার পরিবেশ এবং মানুষের কষ্টের কথা তাদের ব্লগে লিখেছিলেন। তাদের লেখা পড়ে অনেকেই সেই tragedy সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং সহানুভূতি প্রকাশ করেছে।
- আন্দামান সেলুলার জেলে ঘুরতে গিয়ে অনেক GenZ বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবন সম্পর্কে জানতে পেরেছে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে। তারা Social Media-তে সেই অভিজ্ঞতা share করে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করেছে।
৩. ডার্ক ট্যুরিজমের ভালো-খারাপ দিক
৩.১ নৈতিক বিবেচনা
ডার্ক ট্যুরিজমের কিছু নৈতিক দিক (Ethical aspects) আছে, যা আলোচনা করা দরকার।
- মৃতের প্রতি অসম্মান: অনেকে মনে করেন, ডার্ক ট্যুরিজম মৃত মানুষদের প্রতি অসম্মানজনক। তাদের মতে, এই ধরনের জায়গায় ঘুরতে যাওয়া মানে হলো মানুষের কষ্টকে নিয়ে ব্যবসা করা।
- ইতিহাস থেকে শিক্ষা: আবার অনেকে মনে করেন, ডার্ক ট্যুরিজম ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার একটা উপায়। এই ধরনের জায়গায় গেলে মানুষ বুঝতে পারে, অতীতে কী ভুল হয়েছে এবং সেই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার চেষ্টা করে।
- স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব: ডার্ক ট্যুরিজমের কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে (Local economy) কিছু প্রভাব পড়ে। অনেক জায়গায় এই ট্যুরিজমের কারণে নতুন ব্যবসা তৈরি হয় এবং স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান (Employment) হয়।
৩.২ ভালো দিক
ডার্ক ট্যুরিজমের কিছু ভালো দিক নিচে উল্লেখ করা হলো:
- ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা: ডার্ক ট্যুরিজম historical events-কে বাঁচিয়ে রাখে এবং মানুষকে সেই সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
- সচেতনতা তৈরি: এই ধরনের ট্যুরিজম মানুষকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে এবং তাদের মধ্যে সহানুভূতি তৈরি করে।
- স্থানীয় অর্থনীতিকে সাহায্য: ডার্ক ট্যুরিজমের কারণে অনেক জায়গায় নতুন ব্যবসা তৈরি হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে সাহায্য করে।
৩.৩ খারাপ দিক
ডার্ক ট্যুরিজমের কিছু খারাপ দিকও আছে, যা আমাদের মনে রাখতে হবে:
- মৃতের সম্মানহানি: অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ ডার্ক ট্যুরিজম স্পটগুলোতে গিয়ে এমন কিছু কাজ করে, যা মৃত মানুষদের প্রতি অসম্মানজনক।
- ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য: কিছু মানুষ শুধু ব্যবসার জন্য ডার্ক ট্যুরিজমকে ব্যবহার করে। তারা মানুষের কষ্টকে পুঁজি করে টাকা রোজগার করে।
- সংবেদনশীলতার অভাব: অনেক ট্যুরিস্ট (Tourist) এই জায়গাগুলোর প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল (Sensitive) হয় না। তারা হাসাহাসি করে বা এমন কিছু মন্তব্য করে, যা মৃত মানুষদের পরিবারের প্রতি অপমানজনক।
এই সমস্যাগুলো কমানোর জন্য আমাদের উচিত:
- ডার্ক ট্যুরিজম স্পটগুলোতে যাওয়ার আগে সেই জায়গার ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে যাওয়া।
- সেখানে গিয়ে মৃত মানুষদের প্রতি সম্মান দেখানো এবং কোনো ধরনের খারাপ আচরণ না করা।
- স্থানীয় অর্থনীতিকে সাহায্য করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে জিনিসপত্র কেনা।
ভ্রমণ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন অজানাকে জানতে
৪. ডার্ক ট্যুরিজম: কিছু ডেটা ও স্ট্যাটিসটিকস
এখানে কিছু টেবিল আকারে ডেটা দেওয়া হলো, যা ডার্ক ট্যুরিজমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরবে:
টেবিল ১: ভারতে ডার্ক ট্যুরিজমের কিছু জনপ্রিয় স্থান ও দর্শক সংখ্যা (আনুমানিক)
স্থান |
আনুমানিক দর্শক সংখ্যা (বার্ষিক) |
প্রধান আকর্ষণ |
আন্দামান সেলুলার জেল |
২,০০,০০০ + |
বিপ্লবী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস |
ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি মেমোরিয়াল |
১,৫০,০০০ + |
গ্যাস দুর্ঘটনার শিকার ও তাদের জীবন |
জালিয়ানওয়ালা বাগ |
৩,০০,০০০ + |
১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিলের মর্মান্তিক ঘটনা |
টেবিল ২: GenZ-এর মধ্যে ডার্ক ট্যুরিজমের আগ্রহের কারণ (শতাংশ)
কারণ |
শতকরা হার |
ঐতিহাসিক ঘটনা জানার আগ্রহ |
৬০% |
নতুন অভিজ্ঞতা লাভের আকাঙ্ক্ষা |
২৫% |
বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার ইচ্ছে |
১৫% |
ডার্ক ট্যুরিজম একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এটা আমাদের ইতিহাস জানতে, মানুষের কষ্ট বুঝতে এবং সমাজের প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীল হতে সাহায্য করে। তবে, এই ধরনের জায়গায় যাওয়ার সময় আমাদের কিছু নৈতিক দিক মনে রাখতে হবে এবং মৃত মানুষদের প্রতি সম্মান জানাতে হবে। ডার্ক ট্যুরিজম আমাদের সমাজের একটা অংশ এবং এর ভালো-খারাপ দিকগুলো বিবেচনা করে আমাদের নিজেদের মতামত তৈরি করতে হবে।