রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে তিন শিশু—আরিয়ান, বাপ্পি ও হুমায়ের। দশ বছরের আরিয়ান এবং নয় বছরের বাপ্পি ও হুমায়ের সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা হলেও ছিল বন্ধু, সহপাঠী ও খেলার সাথি। গত সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে ঘটা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একসাথে খেলাধুলায় মেতে থাকা তিন শিশু এখন উত্তরার দিয়াবাড়ির তারারটেক মসজিদ এলাকায় পাশাপাশি কবরে শায়িত রয়েছে।
বেলা ১টা ১৮ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়। ঘটনার সময় স্কুল ছুটি হলেও কিছু শিক্ষার্থী কোচিং ক্লাসে অংশ নিচ্ছিল। বিমানটি উড্ডয়নের মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটে, যা সারাদেশে শোকের ছায়া ফেলে দিয়েছে।
প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালেও একসাথে স্কুলে গিয়েছিল তিনটি শিশু। সকাল ১১টায় স্কুল শেষে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির এই শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ের ক্লাসে অংশ নেয়। বেলা দেড়টায় ক্লাস শেষ হওয়ার কথা ছিল। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী বাপ্পি ওই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আবু শাহিনের সন্তান এবং একই ক্লাসের হুমায়ের তার ভাইয়ের ছেলে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া আরিয়ান ছিল মি. শাহিনের চাচাতো ভাই।
জোহরের নামাজ শেষে বাপ্পিকে আনতে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন আবু শাহিন। একসাথেই ফেরার কথা ছিল তার ভাই আরিয়ান ও ভাতিজা হুমায়েরও। কিন্তু পথেই শুনতে পান বিকট আওয়াজ। কিছুটা এগোতেই ধোঁয়ার কুণ্ডুলী দেখে দৌড়ে পৌঁছান স্কুল প্রাঙ্গণে। “কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ” বলেছিলেন মি. শাহিন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বেলা ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও দুর্ভাগ্যবশত এটি মাইলস্টোন স্কুলের দোতলা ভবনে আছড়ে পড়ে।
বিমানটি প্রথমে স্কুলের মাঠে আছড়ে পড়ে, পরে প্রায় ৩০ গজ গর্ত করে এগিয়ে যায়। এরপর দ্বিতল ভবনের নিচতলায় গিয়ে আঘাত করে। বিমানের সামনের অংশ নিচতলার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির একটি শ্রেণিকক্ষে ঢুকে যায়। ঘটনার পরপরই স্কুল ভবনে আগুন ধরে যায়।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে বাপ্পি এবং আরিয়ানকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। হুমায়ের দুর্ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। “গত রাত তিনটায় হাসপাতালে আমার ভাই মারা গেছে। আমার ছেলে বাপ্পি মারা গেছে সবার পরে,” বলেছিলেন মি. শাহিন।
মঙ্গলবার দিয়াবাড়ির তারারটেক মসজিদ এলাকায় পুরো এলাকায় নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। দুদিন আগেও যে আঙিনায় একসাথে খেলাধুলায় মেতে থাকত এই শিশুরা সেখানেই পাশাপাশি কবরে শায়িত হয়েছে তারা। চোখের জলে পরিবারের কনিষ্ঠ তিন সদস্যকে বিদায় জানিয়েছেন স্বজনেরা। অঝোরে কেঁদেছেন বন্ধু, সহপাঠী আর প্রতিবেশীরাও।
নিহত তিন শিশুর জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন অনেক মানুষ। দূর থেকে এক নজর দেখতে এসেছিলেন স্বজন, প্রতিবেশী আর সহপাঠীরাও। “মাত্র একদিন আগে যে শিশুদের একসাথে স্কুলে যেতে অথবা খেলে বেড়াতে দেখলাম, তারা আজ নেই,” বলেছিলেন ওই এলাকার বাসিন্দা মোতালেব হোসেন।
এই বিমান দুর্ঘটনায় মোট ২৭-৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে ২৫ জনই শিশু, একজন পাইলট ও একজন শিক্ষিকা রয়েছেন। আহত হয়েছে অন্তত ১৭১ জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা ৭৮ জনের মধ্যে ২৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন হাসপাতালে আহত ও দগ্ধদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সর্বাধিক রোগী ভর্তি করা হয়েছে। দগ্ধদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
ঘটনার তাৎক্ষণিক সাড়া দিয়ে ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, আনসার, স্কাউটসহ স্বেচ্ছাসেবীরা উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। উত্তরা, টঙ্গী, পল্লবী, কুর্মিটোলা, মিরপুর, পূর্বাচল ফায়ার স্টেশনের আটটি ইউনিট উদ্ধারকাজে অংশ নেয়।
বাংলাদেশে বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে এটি অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন দুর্ঘটনা সারাদেশে গভীর শোক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে বিমানবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছেন বিভিন্ন মহল। মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের এই ট্রাজেডি দেশের মানুষের মনে দীর্ঘদিন রয়ে যাবে। তিন খেলার সাথির এই বিদায় যেমন তাদের পরিবারের জন্য অসহনীয়, তেমনি পুরো জাতির জন্যও গভীর বেদনার বিষয়।