২১ জুলাই ২০২৫, সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিট। ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর আছড়ে পড়ল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকেই ঢাকায় বিমান দুর্ঘটনায় লাশের সঠিক সংখ্যা জানতে চেয়ে উত্তাল রাজধানী হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে ১৮-১৯ জন নিহতের খবর পাওয়া গেলেও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা।
বর্তমানে নিহতের সংখ্যা ৩১ এ পৌঁছেছে, যার মধ্যে ২৫ জনই শিশু। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৬৫ জন। কিন্তু যা আরও উদ্বেগজনক তা হলো, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও স্বচ্ছতার অভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ।
মৃত্যুর সংখ্যায় বিভ্রান্তি: কেন বদলাচ্ছে পরিসংখ্যান?
এই দুর্ঘটনার সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দিক হলো হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণে ক্রমাগত পরিবর্তন। প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল ১৯ জনের মৃত্যুর কথা জানান। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এর তথ্য অনুযায়ী:
- প্রথম দিন: ১৮-১৯ জন নিহত
- সোমবার রাত: ২২ জন নিহত
- মঙ্গলবার সকাল: ২৭ জন নিহত
- মঙ্গলবার দুপুর: ৩১ জন নিহত
কেন এমনটা হচ্ছে?
চিকিৎসকদের মতে, আহতদের বেশিরভাগই মারাত্মক দগ্ধ হয়েছেন। অনেকের শরীর এমনভাবে ঝলসে গেছে যে তাদের চেহারা পর্যন্ত চেনা যাচ্ছে না। এ কারণে তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না অনেক মৃতদেহ। সরকার জানিয়েছে, যাদের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না, তাদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
উত্তাল রাজধানী: প্রতিবাদের আগুনে জ্বলছে উত্তরা
মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও তথ্য গোপনের অভিযোগে ফুঁসে উঠেছে মাইলস্টোনের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সোমবার দিবাগত রাতেই হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চেয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের মূল অভিযোগ ছিল কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের প্রকৃত তথ্য গোপন করছে।
শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি
মঙ্গলবার সকাল ১০টায় মাইলস্টোন কলেজের গোল চত্বরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক দেয় শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রধান দাবিগুলো হলো:
- নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ
- শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ
- নিহতদের পরিবারের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ
- বিমানবাহিনীর পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ বিমান বাতিল
- নিরাপদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন
- ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত
পুলিশের সাথে সংঘর্ষ
প্রতিবাদ চলাকালে শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। এমনকি কিছু শিক্ষার্থী পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এই ঘটনায় পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
বিমান দুর্ঘটনার বিস্তারিত: কী ঘটেছিল সেদিন?
২১ জুলাই সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার এ কে খন্দকার বিমানবাহিনী ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে চীনে তৈরি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি। এটি ছিল নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ। কিন্তু উড্ডয়নের মাত্র ১২-১৩ মিনিটের মধ্যেই বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়।
বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলাম বিপদ বুঝতে পেরে বিমানটিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।
ঘটনাস্থলের ভয়াবহতা
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বিমানটি প্রথমে স্কুলের মাঠে আছড়ে পড়ে। তারপর প্রায় ৩০ গজ গর্ত করে এগিয়ে যেয়ে দ্বিতল ভবনের নিচতলায় আঘাত করে। বিমানের সামনের অংশ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির একটি শ্রেণিকক্ষে ঢুকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে পুরো ভবন।
হাসপাতালে হাহাকার: আত্মীয়দের আর্তচিৎকার
দুর্ঘটনার পর হতাহতদের ঢাকার ৮টি হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীদের বিতরণ:হাসপাতালের নামআহতনিহতজাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট৪৬১০ঢাকা সিএমএইচ২৮১৬উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল৬০১উত্তরা লুবনা জেনারেল হাসপাতাল১৩২কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল৮-
হাসপাতালের বাইরে ভিড় করেছেন শত শত অভিভাবক। স্বজনদের আর্তনাদ-আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে প্রতিটি হাসপাতাল। অনেক পরিবার এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন তাদের প্রিয়জনদের খোঁজে।
চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বেশিরভাগ রোগীই মারাত্মক দগ্ধ। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ডাক্তাররা জানিয়েছেন, রক্তদানের জন্য যথেষ্ট দাতা রয়েছে, তবে নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন রয়েছে।
সরকারি পদক্ষেপ ও তদন্ত কমিটি গঠন
এই মর্মান্তিক ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার একদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির গঠন
দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনে বিমানবাহিনী একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি যান্ত্রিক ত্রুটির সঠিক কারণ এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায় খতিয়ে দেখবে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
গণসংহতি আন্দোলন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, এই বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির অপচেষ্টা হতে পারে। তারা সকলকে ধৈর্য ধরে সত্যিকারের তথ্যের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
এই দুর্ঘটনা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিমানবাহিনীর ঘাঁটির এত কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা নিরাপদ নয়।
পুরনো বিমানের ঝুঁকি
বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এফ-৭ বিজিআই একটি পুরনো মডেলের বিমান। এর রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষার্থীরা দাবি করেছে, এমন পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বাতিল করা হোক।
ব্যক্তিগত বেদনার গল্প
এই দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে অসংখ্য পরিবারের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি। মুকুল হোসেন নামে এক বাবা তার ছেলে সূর্যকে নিতে গিয়ে নিজেই আহত হয়েছেন। বিমানের পাখার একটি অংশ এসে লাগে তার বুকে। এমন অসংখ্য গল্প রয়েছে যা হৃদয়বিদারক।
আবার কিছু পরিবারে একসাথে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ক্ষতি পূরণের কোনো উপায় নেই। শুধুমাত্র সঠিক ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচার দিয়েই সরকার কিছুটা সান্ত্বনা দিতে পারে।
এগিয়ে যাওয়ার পথ
এই ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকে। প্রয়োজন:
- স্বচ্ছতা: সরকারের পক্ষ থেকে সকল তথ্য স্বচ্ছভাবে প্রকাশ
- জবাবদিহিতা: দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
- ক্ষতিপূরণ: নিহত ও আহতদের পরিবারের যথাযথ ক্ষতিপূরণ
- নিরাপত্তা: ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা
উপসংহার
ঢাকায় বিমান দুর্ঘটনায় লাশের সঠিক সংখ্যা জানতে চেয়ে উত্তাল রাজধানীর এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, সঠিক তথ্য ও স্বচ্ছতার অভাবে কীভাবে একটি ট্র্যাজেডি আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। ৩১ জনের প্রাণহানি ও ১৬৫ জনের আহত হওয়ার এই ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং আমাদের সিস্টেমের ত্রুটিগুলোকেও তুলে ধরেছে। এখন প্রয়োজন সত্যিকারের পরিবর্তন ও জবাবদিহিতা, যাতে ভবিষ্যতে এমন ট্র্যাজেডি এড়ানো যায়। আপনার মতামত জানান মন্তব্যে – এই দুর্ঘটনা থেকে আমাদের কী শিক্ষা নেওয়া উচিত?