পাতলা পায়খানার ট্যাবলেট: চিকিৎসা ব্যবস্থায় কার্যকর সমাধান

Debolina Roy 6 Min Read

diarrhea tablets Bangladesh: পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া বাংলাদেশের একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। এই রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ওআরএস, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি-ডায়রিয়াল ট্যাবলেট এবং অন্যান্য সহায়ক চিকিৎসা। বাংলাদেশে উপলব্ধ পাতলা পায়খানার ট্যাবলেট এবং তাদের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রতিটি পরিবারের জন্য জরুরি।

ওআরএস (ORS): পাতলা পায়খানার প্রথম ও প্রধান চিকিৎসা

 পাতলা পায়খানার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হচ্ছে ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট। ওআরএসের উন্নয়ন বাংলাদেশেই হয়েছিল এবং দেশটি এ ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৪% পাতলা পায়খানার রোগী ওআরএস ব্যবহার করেন, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ হারগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশে জনপ্রিয় ওআরএস ব্র্যান্ড:

ORSaline-N (SMC): সামাজিক বিপণন সংস্থার (SMC) প্রোডাক্ট ORSaline-N বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড। ১৯৮৫ সালে চালু হওয়ার পর থেকে এটি লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। প্রতি ২৫ পিস প্যাকেটের দাম সাশ্রয়ী এবং দেশের প্রতিটি কোণে পাওয়া যায়।

New ORS-A: আদ-দীন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের এই পণ্যটি ১০.২৫ গ্রাম প্যাকেটে পাওয়া যায়।

Rice ORS: স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের চাল-ভিত্তিক ওআরএস, যা ২৫০ মিলি ও ৫০০ মিলি প্যাকেটে পাওয়া যায়। প্রতি ১০ পিসের প্যাকেটের দাম ১০০-১৭০ টাকা।

ঢাকার সেরা কিডনি ডাক্তার: যারা আপনার কিডনি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা

অ্যান্টি-ডায়রিয়াল ট্যাবলেট: লোপেরামাইড গ্রুপ

পাতলা পায়খানার চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকর অ্যান্টি-ডায়রিয়াল ট্যাবলেট হচ্ছে লোপেরামাইড গ্রুপের ওষুধগুলো।

Imotil (Square Pharmaceuticals)

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাতলা পায়খানার ট্যাবলেট হচ্ছে Imotil। এর প্রতিটি ক্যাপসুলে ২ মিলিগ্রাম লোপেরামাইড হাইড্রোক্লোরাইড রয়েছে।

দাম: প্রতি ক্যাপসুল ১ টাকা, ১০ পিসের স্ট্রিপ ১০ টাকা।

ব্যবহার:

  • তীব্র পাতলা পায়খানার জন্য প্রাপ্তবয়স্করা প্রথমে ২টি ক্যাপসুল খাবেন
  • এরপর প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১টি করে ক্যাপসুল
  • দৈনিক সর্বোচ্চ ৮টি ক্যাপসুল

Imotil কার্যকর কারণ এটি অন্ত্রের সংকোচন ধীর করে দেয় এবং খাবার অতিক্রমের গতি কমিয়ে দেয়। ফলে শরীর বেশি পানি ও পুষ্টি উপাদান শোষণ করতে পারে এবং পায়খানা শক্ত হয়।

অন্যান্য লোপেরামাইড ব্র্যান্ড

বাংলাদেশে আরও কয়েকটি লোপেরামাইড ব্র্যান্ড পাওয়া যায়:

  • Lopamide Tablet: প্রতি ট্যাবলেট ২.৫ টাকা
  • Diarsec 2mg Tablet: বায়োকেম ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের পণ্য
  • Ridol 2mg Tablet: গুফিক বায়োসায়েন্স লিমিটেডের পণ্য

রেসেকাডোট্রিল গ্রুপ: আধুনিক চিকিৎসা

Racetril (Incepta Pharmaceuticals)

রেসেকাডোট্রিল একটি আধুনিক অ্যান্টি-ডায়রিয়াল ওষুধ যা তীব্র পাতলা পায়খানার উপসর্গ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

প্রাপ্তবয়স্কদের ডোজ: প্রথমে ১টি ক্যাপসুল, তারপর দিনে তিনবার খাবারের আগে ১টি করে।

শিশুদের ডোজ: ওজন অনুযায়ী নির্ধারিত, ৩ মাস বয়স থেকে ব্যবহার করা যায়।

বিসমুথ সাবসালিসিলেট: পেট ব্যথা ও ডায়রিয়ার জন্য

Pepto-Care (Unimed Unihealth)

বিসমুথ সাবসালিসিলেট হচ্ছে একটি অ্যান্টি-ডায়রিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধ। এটি বমি বমি ভাব, বদহজম, পেট খারাপ এবং পাতলা পায়খানার উপসর্গ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

দাম: ২০০ মিলি বোতল ১৫০ টাকা

ডোজ:

  • প্রাপ্তবয়স্ক: খাবারের ৩০ মিনিট আগে দিনে ৩-৪ বার ৩০ মিলি
  • শিশু (৩-১২ বছর): ৫-১৫ মিলি

অ্যান্টিবায়োটিক গ্রুপ: সংক্রমণের চিকিৎসায়

মেট্রোনিডাজল (Flagyl/Metronidazole)

= পাতলা পায়খানার চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে মেট্রোনিডাজল। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তীব্র ডায়রিয়ায় এর ব্যবহারের বিরুদ্ধে পরামর্শ দেয়, তবুও বাংলাদেশে ৭৯-৯৬% ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয়।

কার্যকারিতা: আমিবিয়াসিস এবং জিয়ার্ডিয়াসিসের মতো পরজীবী সংক্রমণে কার্যকর।

সাধারণ ব্র্যান্ড: Flagyl ৪০০ মিগ্রা ট্যাবলেট

অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিন

ব্যাকটেরিয়াল ডায়রিয়ার চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিন এবং সিপ্রোফ্লক্সাসিন ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে রক্তযুক্ত পাতলা পায়খানা বা ডিসেন্ট্রির ক্ষেত্রে এগুলো কার্যকর।

জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট: শিশুদের জন্য অত্যাবশ্যক

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সুপারিশ অনুযায়ী, শিশুদের পাতলা পায়খানার চিকিৎসায় ওআরএসের সাথে জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট দেওয়া উচিত।

জিঙ্কের উপকারিতা

বাংলাদেশে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট:

  • ডায়রিয়ার মেয়াদ ২৪ ঘন্টা কমিয়ে দেয়
  • ডায়রিয়ার ঘটনা ১৫% কমায়
  • হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা কমায়

ডোজেজ

  • ৬ মাসের কম বয়সী শিশু: দৈনিক ১০ মিলিগ্রাম
  • ৬-৫৯ মাস বয়সী শিশু: দৈনিক ২০ মিলিগ্রাম
  • ১০-১৪ দিন পর্যন্ত সেবন করতে হয়

তবে বাংলাদেশে মাত্র ৩৯.২৪% শিশু ঘরে জিঙ্ক গ্রহণ করে, যা লক্ষ্যের তুলনায় অনেক কম।

প্রোবায়োটিক্স: উপকারী ব্যাকটেরিয়া

 শিশুদের ডায়রিয়া চিকিৎসায় প্রোবায়োটিক্সের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬.৪% প্রেসক্রিপশনে প্রোবায়োটিক পণ্য রয়েছে।

কার্যকর প্রোবায়োটিক

 সবচেয়ে বেশি নির্ধারিত প্রোবায়োটিক স্পিসিস হচ্ছে:

  • Bacillus
  • Lactobacillus

এগুলো ডায়রিয়ার মেয়াদ কমায় এবং দ্রুত হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে সহায়তা করে।

পাতলা ভ্রু ঘন করার ৭টি সহজ ও কার্যকরী উপায়

সঠিক ব্যবহারের নির্দেশনা

কখন ডাক্তার দেখাবেন

  • রক্তযুক্ত পাতলা পায়খানা হলে
  • উচ্চ জ্বর থাকলে (১০১°F এর বেশি)
  • ২ দিনের বেশি ডায়রিয়া থাকলে
  • গুরুতর পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে

ওষুধ ব্যবহারের সতর্কতা

লোপেরামাইড (Imotil):

  • রক্তযুক্ত পাতলা পায়খানায় ব্যবহার করা যাবে না
  • শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন
  • গর্ভকালে ডাক্তারের পরামর্শ নিন

অ্যান্টিবায়োটিক:

  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করবেন না
  • সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করুন
  • প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করলে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হতে পারে

দাম ও সহজলভ্যতা

বাংলাদেশের পাতলা পায়খানার ওষুধগুলো অত্যন্ত সাশ্রয়ী:

  • ওআরএস প্যাকেট: ৬-১৭ টাকা প্রতি প্যাকেট
  • Imotil ক্যাপসুল: ১ টাকা প্রতি পিস
  • Pepto-Care সাসপেনশন: ১৫০ টাকা ২০০ মিলি বোতল

এই ওষুধগুলো দেশের সব ফার্মেসি ও মুদি দোকানে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০% ব্যবহারকারী স্থানীয় দোকান বা ফার্মেসি থেকে ওআরএস কিনে থাকেন।

বাংলাদেশে পাতলা পায়খানার চিকিৎসায় কো-প্যাকেজিং পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, ওআরএস ও জিঙ্ক একসাথে প্যাকেট করা হবে যাতে রোগীরা দুটোই একসাথে ব্যবহার করেন। এ পদ্ধতিতে ৯৩% পর্যন্ত মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব।

পাতলা পায়খানার চিকিৎসায় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অগ্রগামী একটি দেশ। ওআরএসের জন্মভূমি এই বাংলাদেশেই এবং এর ব্যবহারের হার বিশ্বের সর্বোচ্চ। তবে জিঙ্কের ব্যবহার আরও বৃদ্ধি করা এবং অযৌক্তিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার কমানোর দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে পাতলা পায়খানা একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর।

Share This Article