বাংলা চলচ্চিত্র জগতে জনপ্রিয় একজন অভিনেতা হলেন তাপস পাল। তিনি বাংলা, হিন্দি এবং ওড়িয়া ভাষা মিলিয়ে ৪০০রও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। দাদার কীর্তি থেকে শুরু করে সাহেব, অনুরাগের ছোঁয়া , ভালোবাসা ভালোবাসা বলিদান, আটটা আটের বনগাঁ লোকাল, আই লাভ ইউ, চ্যালেঞ্জ ২, খিলাড়ির মতো সিনেমাতে তার অভিনয় রীতিমত তুলনাহীন। বাংলা চলচ্চিত্রে দেবশ্রী রায় থেকে শুরু করে শতাব্দী রায়, ইন্দ্রানী হালদার এমনকি দুরন্ত প্রেম ছবিতে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন তিনি। তবে অনেকেই জানেন না তাপস পাল শুধু বাংলা চলচ্চিত্রে নয় হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। হিন্দির জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিতের প্রথম নায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সাথে অবোধ ছবিতে মাধুরীর অভিনীত চরিত্র গৌরীর স্বামী শঙ্করের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। আট ও নয়ের দশকে একাধিক ছবিতে অভিনয় করার পাশাপাশি সাহেব ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান।
তার অভিনয় জীবনের গ্রাফ সবসময় ঊর্ধ্বমুখী ছিল। প্রথমদিকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করলেও শেষ বয়সে তিনি নায়কের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেও দর্শকের মনে একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন। তবে তার অভিনয় জীবনের মত তার রাজনৈতিক জীবন এতটা মসৃণ নয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহু উত্থান পতনের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। তাপস পালের সহকর্মীরা মনে করেন রাজনীতিতে যোগ দেওয়ায় তার জীবনের একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল! তাপস পালের একসময়ের বন্ধু কংগ্রেসের মুখ্য সচেতক অসিত মিত্র বলেন তাপস পালের জীবনের বিপর্যয়ের মূল কারণ রাজনীতি! কোথাও গিয়ে হয়ত সত্যিই তাই, রাজনীতিতে দুবারের বিধায়ক, দু’বারের সাংসদকে তাই চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে জেলে পর্যন্ত ঢুকতে হয়েছে। একটি জনসভায় নেতা হিসেবে গিয়ে মহিলাদের বিষয়ে করা তার হুমকিমূলক একটি মন্তব্য যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে তার এই বক্তব্যের জন্য তিনি বহুবার ক্ষমা চেয়েছেন তবুও কোথাও গিয়ে তার অসতর্কতাবশত করে ফেলা সেই মন্তব্যই তাকে ভেতরে ভেতরে কষ্ট দিয়ে গিয়েছে ও তার জীবনীশক্তিকে শেষ করে দিয়েছে বলেই মনে করেন অভিনেতার পরিবার।
মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করা যেমন গর্বের তেমনি চাপের’শাস্ত্রীতে অভিনয় নিয়ে বললেন কোলাজ!
২৯ শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে হুগলির চন্দননগরের এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা তাপস পাল কলেজের শিক্ষা শেষ করেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। ১৯৮০ সালে তরুণ মজুমদারের দাদার কীর্তি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি, এই ছবিতে মহুয়া রায় চৌধুরীরর বিপরীতে সহজ সরল দাদা কেদারের চরিত্রে অভিনয় করে রীতিমত মানুষের মনের মনিকোঠায় দাগ কেটেছেন তাপস পাল। এরপরেও মহুয়ার সাথে জুটি বেঁধে একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তাপস পাল শুধু মহুয়ায় নয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম জনপ্রিয় তিন অভিনেত্রী শতাব্দী রায়, দেবশ্রী রায় ও ইন্দ্রানী হালদারের সঙ্গেও তার জুটি হিট। গুরুদক্ষিণা, আমার তুমি আমার, অন্তরঙ্গ ইত্যাদি ছবিতে শতাব্দী তাপস পালের সমীকরণ এক আলাদা উত্তেজনার সৃষ্টি করে দর্শক মনে। এছাড়া দেবশ্রী রায়ের সাথে জুটি বেঁধে করেছেন অর্পন , সুরের সাথী, সুরের আকাশে, নয়ন মনি, চোখের আলোয়, তবু মনে রেখো-র মত একটার পর একটা হিট ছবি। এ ছাড়া ইন্দ্রানী হালদার থেকে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীদের সাথেও পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়ের ক্ষেত্রে সহজ সরল সাদামাটা চরিত্রে অভিনয় করেই তিনি দর্শকের মনের মধ্যে নিজের জন্য এক সম্মানীয় জায়গা করে নিয়েছিলেন, দর্শক তাকে ঘরের ছেলে ভাবত!
অথচ এই সম্মানের জায়গায় ভুলন্ঠিত হয়েছিল রাজনীতিতে এসে! রাজনীতিতে আসাটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল জনপ্রিয় অভিনেতা তাপস পালের জীবনে! হ্যাঁ , একটা সময় বড় পর্দা থেকে নিজেকে সরিয়ে অভিনেতা রাজনীতির ময়দানে আসেন। ২০০১ সাল থেকে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি, সেই সময় কলকাতার আলিপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়ে বিধানসভা ভোটে জয়ী হন তিনি। এরপর ২০০৬ সালেও ওই আসন থেকেই ভোটে দাঁড়িয়ে বিপ্লব চক্রবর্তীর বিপক্ষে বিপুল ভোটে জেতেন তাপস পাল। ২০০৯ এর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনের টিকিট দেয়, সেই বছর সিপিএমের জ্যোতির্ময় শিকদারকে হারিয়ে আসনটি যেতেন তাপস, ২০১৪র লোকসভা নির্বাচনেও দ্বিতীয়বার জয়যুক্ত হয়ে সাংসদ হন তাপস পাল।
২০১৪র লোকসভা নির্বাচনের পর একটি জনসভায় তিনি বিরোধী দলের মানুষদের ওপর নিজের দলীয় সমর্থকদের হামলা চালানোর জন্য ও মহিলাদের উপর অত্যাচার করার জন্য উস্কানিমূলক এক মন্তব্য করেন যে মন্তব্যের জন্য পরে তাকে খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। কিন্তু তার সেই মন্তব্য তাকে সেই সময় জনগণের চোখে নীচে নামিয়ে দেয়, এমনকি দাদার কীর্তি খ্যাত অভিনেতার কুশ পুতুলও দাহ করা হয়। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচনের আগে একটি প্রচার সভায় তাপস পাল নিজেকে চন্দননগরের মাল বলে পরিচয় দিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন। তারকা সাংসদ তাপস পাল বলেন,“যদি কোনও বিরোধী আজকে তৃণমূলের কোনও মেয়ে, কোন বাপ, কোন বাচ্চার গায়ে হাত দেয়, তাদের গুষ্টিকে আমি… যা তা করে চলে যাব। আমার ছেলেদের ঢুকিয়ে দেব, রেপ করে চলে যাবে, রেপ করে চলে যাবে। ” পরে এই নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হলে তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। এরপর ২০১৬ সালের শেষ দিকে রোজভ্যালি বিতর্কে আবার তার নাম জড়ায়।
২০১৬র ৩০ শে ডিসেম্বর রোজভ্যালির চিটফান্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ও ১৩ মাস জেলবন্দি থাকার পর ২০১৮ র ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি পান তিনি। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর ঈশ্বরের নাম করে তার আকুল কান্নার একটি ভিডিও সেই সময় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। তবে বিতর্কিত ওই মন্তব্যের জন্য অনেক কাছের মানুষও তার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন, যেটা মানতে পারেন নি অভিনেতা। এই মন্তব্যের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন নি অভিনেতা এমনটাই দাবি করেন তার স্ত্রী নন্দিনী পাল ও মেয়ে সোহিনী পাল। একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিনেতার স্ত্রী নন্দিনী বলেন,“ওই মন্তব্যের জন্য কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেননি তাপস। পরিবার হিসেবে আমরাও ক্ষমা করিনি। আজও লজ্জিত এবং দুঃখিত আমরা। যতটা দুঃখিত উনি ছিলেন, ততটাই। এর কোনও অজুহাত হয় না। তাপস বলেছিলেন, উনি পাপ করেছেন। তাই জেলযাত্রার পর বলেন, ‘ভালই হয়েছে,পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে’।”
জেলবন্দি অবস্থাতেই স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত হন অভিনেতা, এমনকি ২০১৭ সালের মার্চ মাসে বন্দী দশাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে তার যোগাযোগ ক্রমশ কমে যায়, সাংসদ হিসেবেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন তিনি। এরপর ২০২০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে মাত্র ৬১ বছর বয়সে মারা যান অভিনেতা তাপস পাল। শেষ জীবনে বেশিরভাগ সময় অসুস্থতার মধ্যে কাটালেও শোনা যায় এই সময়ে আবার অভিনয় ফিরে আসতে চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু তার ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। অনেকেই বলেন, সিনেমা করে তিনি যে নাম, খ্যাতি, যশ পেয়েছিলেন, রাজনীতি তার সবটুকুকে শেষ করে দেয়, বিচক্ষণ অভিনেতা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেতেন আর তার সেই মনের কষ্টই তাকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়।
তাপস পালের মৃত্যুর পর বিজেপি মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেছিলেন,‘ রাজনীতির মারপ্যাঁচ, যে নোংরামোটা হয়, সেখানে তাপসদার মতো মানুষ একটু বেশি-ই বিপজ্জনক পরিস্থিতির শিকার হয়।’ আবার কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা বলেন,“রাজনীতির জগতে না এলে তাপস পালের অকাল মৃত্যু ঘটত না”। আসলে অভিনেতা হঠাৎ অভিনয় ছেড়ে রাজনীতিতে আসার কারণ