New Jagannath Temple in Digha: ৩০শে এপ্রিল ২০২৫, অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ দিনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী দীঘায় নির্মিত নতুন জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন করতে চলেছেন। পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত এই অভিনব প্রকল্প দীঘাকে একটি নতুন পর্যটন ও তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছে, যা বাঙালিদের জন্য এখন আর পুরী যেতে হবে না জগন্নাথ দর্শনের জন্য। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মন্দির শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই নয়, রাজনৈতিক বলয়েও উল্লেখযোগ্য আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
দীঘায় জগন্নাথ ধাম: স্বপ্ন থেকে বাস্তবে
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ২০১৯ সালে প্রথম এই মন্দির নির্মাণের ঘোষণা করেছিলেন। করোনা মহামারীর কারণে প্রকল্পটি কিছুটা বিলম্বিত হলেও, এখন তা সম্পূর্ণ হয়েছে এবং উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত। মন্দিরটি ২০ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে, যেখানে পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার, প্রশাসনিক ভবন, পুলিশ ফাঁড়ি এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা এখানে স্থানীয় পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।
“এই মন্দির নিশ্চিতভাবে রাজ্যের মুকুটে একটি নতুন পালক যোগ করবে। দীঘা একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হবে। এটি একটি সম্প্রীতির স্থান হিসেবে কাজ করবে। সমুদ্রের কারণে দীঘার একটি বিশেষ আকর্ষণ আছে। এখন, যদি এটি তীর্থস্থান হয়ে ওঠে, আরও বেশি পর্যটক আসবেন,” মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন।
মন্দিরের বিশেষত্ব: কালিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নমুনা
জগন্নাথ ধাম ঐতিহ্যবাহী কালিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত হয়েছে। মন্দিরটির উচ্চতা ৬৫ মিটার (২১৩ ফুট), যা অঞ্চলের অন্যতম উঁচু মন্দির কাঠামো। এর নির্মাণে রাজস্থান থেকে আনা গোলাপী বালিপাথর ব্যবহার করা হয়েছে। ৮০০ জনেরও বেশি দক্ষ কারিগর এই স্থাপত্য আশ্চর্য নির্মাণে তাদের দক্ষতা উৎসর্গ করেছেন।
মন্দির কমপ্লেক্সে পুরীর মন্দিরের অনুরূপ মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন ভোগ মণ্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন এবং পবিত্র গর্ভগৃহ (সেন্টাম স্যাঙ্কটোরাম), সবই জটিল নকশা এবং দেবতার মূর্তি দিয়ে সজ্জিত। কালো পাথর দিয়ে তৈরি ৩৪ ফুট লম্বা, ১৮ মুখী অরুণ স্তম্ভ, যার শীর্ষে অরুণা মূর্তি রয়েছে, মন্দিরের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে।
দীঘা ধাম পুরীর মূল মন্দিরের নকশা প্রতিফলিত করে, সিংহদ্বার, ব্যাঘ্রদ্বার, হস্তিদ্বার এবং অশ্বদ্বার সহ অনুরূপ স্থাপত্যগত উপাদান রয়েছে। কমপ্লেক্সে একটি নিবেদিত লক্ষ্মী মন্দির এবং পবিত্র ভোগ প্রস্তুত করার জন্য একটি আলাদা ভোগশালা রয়েছে।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান: আধ্যাত্মিক উৎসবের আমেজ
মঙ্গলবার বিকেলে দীঘার নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরে ‘মহা যজ্ঞ’ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী অনুষ্ঠানের এক দিন আগে নিজে রীতিনীতিতে অংশ নিয়েছেন। বিকেল ৪:১৫ মিনিটে আরতি ও পূর্ণাহুতি অনুষ্ঠান শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন পুরী জগন্নাথ মন্দিরের সেবাদার রাজেশ দ্বৈতপতি এবং ইসকন, বাংলার উপাধ্যক্ষ রাধারমণ দাস।
দীঘা একটি ধর্মীয় উৎসবের আয়োজক হিসেবে নতুন রূপ পেয়েছে। যানবাহন চলাচলের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে যত্ন সহকারে নীল কার্পেট বিছানো হয়েছে। মঙ্গলবার শহরের প্রায় প্রতিটি কোণে বিশাল স্ক্রিন, পোস্টার এবং ভগবান জগন্নাথের সৃজনশীল চিত্র সাজানো হয়েছে।
“সব ধর্ম ও জাতির মানুষ এখানে এসেছে। সবাই আমাদের অতিথি। ধর্ম কখনও মুখে প্রচার করা হয় না। ধর্ম এমন একটি জিনিস যা হৃদয়কে স্পর্শ করে… আমি সবার জন্য প্রার্থনা করছি,” উদ্বোধনের আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন।
রাজনৈতিক বিতর্ক: মন্দির নাকি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র?
দীঘার জগন্নাথ মন্দির নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধিতা পুনরায় জেগে উঠেছে। বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পল অভিযোগ করেছেন যে মুখ্যমন্ত্রী মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।
“পুরীতেই একমাত্র জগন্নাথ মন্দির আছে। তিনি হিন্দুদের বোকা বানাতে চেষ্টা করছেন বলে যে এটা জগন্নাথ ধাম। কাগজে এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে দেখানো হচ্ছে। এটি তার ভোট ব্যাংক রাজনীতি,” পল বলেছেন।
পক্ষান্তরে, তৃণমূল রাজ্য মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য বিজেপিকে পাল্টা আক্রমণ করেছেন। “বিজেপি মমতা ব্যানার্জীর বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলা-বিরোধী হয়ে গেছে। এখন তারা জগন্নাথদেব-বিরোধী হয়ে গেছে। দীঘার ট্রেনগুলো বাতিল করা হয়েছে। তারা জগন্নাথ ধামকে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলছেন,” তিনি বলেছেন।
মন্দির পরিচালনা ব্যবস্থা: সর্বধর্ম সমন্বয়
মন্দিরটি পরিচালনার জন্য মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। ট্রাস্টের সদস্য সংখ্যা হবে ১৫-২০ জন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমি সদস্য নই, আমি সাহায্য করতে এখানে আছি। ট্রাস্টিদের মধ্যে জেলা শাসক ও পুলিশ সুপার থাকবেন। ইসকন থেকে পাঁচজন পুরোহিত, সনাতন ট্রাস্ট থেকে চারজন এবং চারজন স্থানীয় পুরোহিত থাকবেন। তাদের সঙ্গে কর্মীরাও থাকবেন।”
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা নিয়ম অনুসারে ট্রাস্ট স্থাপন করেছি এবং আমরা আইনি মতামত নিয়েছি। বোর্ড রথের রুট নির্ধারণ করবে।”
দীঘার পর্যটন উন্নয়নে নতুন দিগন্ত
জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনের মাধ্যমে দীঘার পর্যটন ব্যবস্থায় একটি নতুন মাত্রা যোগ হতে চলেছে। বাংলার প্রিয় সমুদ্র সৈকত শহর এখন ধর্মীয় পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিত হবে। পুরীর জগন্নাথ মন্দির ওড়িশার একটি প্রধান আকর্ষণ, যা সারা বছর লাখ লাখ ভক্তকে আকর্ষণ করে, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ রয়েছে।
দীঘায় নবনির্মিত মন্দিরটি স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারাও এখানে তাদের পণ্য বিক্রির সুযোগ পাবেন, যা তাদের আর্থিক উন্নয়নে সহায়তা করবে। মন্দির কমপ্লেক্সের সাথে সংযুক্ত অতিথিশালা ও বিশ্রামাগার পর্যটকদের দীর্ঘ সময় থাকার সুবিধা প্রদান করবে।
উপসংহার: আধ্যাত্মিকতা ও পর্যটনের সংযোগ
দীঘার জগন্নাথ মন্দির পশ্চিমবঙ্গের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর উদ্যোগে বাস্তবায়িত এই প্রকল্প শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই নয়, পর্যটন উন্নয়ন এবং স্থানীয় অর্থনীতির বিকাশেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
রাজনৈতিক বিতর্ক সত্ত্বেও, দীঘার জগন্নাথ মন্দির বাঙালিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। পুরী যাওয়ার প্রয়োজন ছাড়াই এখন বাঙালিরা তাদের বাড়ির কাছে জগন্নাথের দর্শন পাবেন। সরকারের এই উদ্যোগ ধর্মীয় পর্যটনকে উৎসাহিত করবে এবং সেই সাথে স্থানীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে।