ভারতে ডিজিটাল প্রতারণার মহামারী: ২৪ লক্ষ ঘটনায় ৪,২৪৫ কোটি টাকার ক্ষতি, প্রশ্নের মুখে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ A

ভারতে অনলাইন প্রতারণার চিত্র এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই দেশে ২ৄ লক্ষ ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে ক্ষতি হয়েছে বিপুল ৪,২৪৫ কোটি টাকা। মোবাইল ব্যাংকিং, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড এবং…

Chanchal Sen

 

ভারতে অনলাইন প্রতারণার চিত্র এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই দেশে ২ৄ লক্ষ ডিজিটাল প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে ক্ষতি হয়েছে বিপুল ৪,২৪৫ কোটি টাকা। মোবাইল ব্যাংকিং, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড এবং অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে এই জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে বলে সরকারি তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংসদে পেশ করা অর্থমন্ত্রকের লিখিত তথ্য অনুযায়ী, এই পরিসংখ্যান আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের ১০ বছর পূর্তিতে এই পরিসংখ্যান সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর নীতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিজিটাল প্রতারণার সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ, যেখানে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২,৫৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে ঘটনার সংখ্যা ৪ লক্ষ এবং আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১,৭০০ কোটি টাকা বেড়েছে।

তবে আশার দিক হলো, এই ২৪ লক্ষ অভিযোগের মধ্যে ১৩ লক্ষ মামলায় ৪,৩৪৬ কোটি টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এটি দেশের সাইবার অপরাধ দমন ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতি আরো গুরুতর হয়ে উঠেছে ২০২৫ সালে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই ভারতীয় নাগরিকরা সাইবার প্রতারণায় প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা হারিয়েছেন। জানুয়ারিতে ১,১৯২ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ৯৫১ কোটি, মার্চে ১,০০০ কোটি, এপ্রিলে ৭৩১ কোটি এবং মে মাসে ৯৯৯ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

প্রতারণার মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত বলে তদন্তে উঠে এসেছে। কম্বোডিয়া, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ডে সক্রিয় প্রতারণা চক্রগুলির বেশিরভাগই চীনা নিয়ন্ত্রণাধীন বলে জানা গেছে। এই চক্রগুলি অত্যন্ত নিরাপত্তাবেষ্টিত কম্পাউন্ডে প্রতারণা চালায় এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের পাচার করে জোরপূর্বক সাইবার অপরাধে যুক্ত করে।

প্রতারকরা প্রধানত তিনটি কৌশল অবলম্বন করে থাকে। স্টক ট্রেডিং ও ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যামে ভুয়া অ্যাপ ও ওয়েবসাইট ব্যবহার করে উচ্চ লাভের প্রলোভন দেখায়। ডিজিটাল অ্যারেস্ট স্ক্যামে ভুয়া পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তার পরিচয়ে ফোন করে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে জরিমানার নামে অর্থ আদায় করে। আর টাস্ক বেসড স্ক্যামে সহজ কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধাপে ধাপে ‘বিনিয়োগের’ নামে টাকা নেয়।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি এই প্রতারণার ভয়াবহতা তুলে ধরে। পুরান ঢাকার এক ব্যাংক কর্মকর্তা মাত্র ১০ দিনে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা হারিয়েছেন অনলাইন বিনিয়োগের ফাঁদে পড়ে। বেঙ্গালুরুর এক প্রযুক্তিকর্মী সাইবার প্রতারণার শিকার হয়ে ১১ কোটি টাকা হারিয়েছেন। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ প্রতারণার মাধ্যমে বেঙ্গালুরুর ২ ব্যবসায়ী ২.১৫ কোটি টাকারও বেশি হারিয়েছেন।

ভারত সরকার এই সমস্যা মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল পেমেন্টস ফ্রড ইনফরমেশন রেজিস্ট্রি (CPFIR) প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে প্রতারণার অভিযোগ নথিভুক্ত করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রতারণা চিহ্নিতকরণ পদ্ধতিও চালু করা হয়েছে।

সিটিজেন ফিনান্সিয়াল সাইবার রিপোর্টিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে সরকার এক লক্ষ চল্লিশ হাজার সন্দেহভাজন মোবাইল সংযোগ বাতিল করেছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিল্লিতে ভারত ও কম্বোডিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকে প্রতারণা কম্পাউন্ডগুলির সঠিক অবস্থান জানিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কম্বোডিয়ায় ৪৫টি, লাওসে ৫টি এবং মায়ানমারে ১টি বড় প্রতারণা কম্পাউন্ড চিহ্নিত হয়েছে।

সরকার একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় প্যানেল গঠন করেছে, যা দেশের ব্যাংকিং, টেলিকম ও ইমিগ্রেশন সেক্টরে সাইবার প্রতারণার ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন জাল পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে সিম জারিকারী পয়েন্ট অফ সেল এজেন্টদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

এই পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদী ভারতকে ‘ডিজিটাল’ করার বার্তা দিয়েছিলেন এবং ‘নগদবিহীন লেনদেনের’ উপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের সাইবার প্রতারণাকে ‘নতুন রূপের মানব পাচার’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন, যেখানে প্রযুক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিপন্ন করা হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপে ভারতে প্রায় ৬০ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে, যা প্রতারকদের জন্য একটি বিপুল প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।

নাগরিক সচেতনতার ক্ষেত্রে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৩০২টি জেলার ২৩,০০০ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে গত তিন বছরে ৪৭% মানুষ আর্থিক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ৪৩% মানুষ ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি এবং ৩৬% ইউপিআই লেনদেনে প্রতারণার কথা জানিয়েছেন।

প্রতারণার স্থানীয় উদাহরণও উঠে এসেছে। নড়াইলে অনলাইনে পোশাক বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ২৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দুই ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকায় সিআইডি ‘আউটসোর্সিং’ কাজের নামে প্রতারণাকারী দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে।

ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরো জটিল হতে পারে কারণ প্রতারকরা ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল ব্যবহার করছে। টেলিগ্রামে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের মুনাফার লোভ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অজানা ব্যক্তি বা সংস্থার প্রলোভনে পড়ে অনলাইন বিনিয়োগ বা অর্থ লেনদেন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কোনো সন্দেহজনক অ্যাপ, ফোনকল বা লিংক পেলে সঙ্গে সঙ্গে www.cybercrime.gov.in-এ অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে তুলেছে যে, ডিজিটাল রূপান্তরের সাথে সাথে সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও সমানুপাতিক উন্নতি প্রয়োজন। ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রকল্পের সাফল্যের জন্য শুধু প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নয়, বরং নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।