অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান! জেনে নিন ২০২৫ সালের দীপাবলি ও ধনতেরাসের সঠিক দিনক্ষণ ও তাৎপর্য।

Diwali 2025 Date and Schedule: দীপাবলি, অর্থাৎ আলোর উৎসব, ভারতের অন্যতম প্রধান এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এই উৎসব শুধু হিন্দুধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও পালন করে…

Srijita Chattopadhay

 

Diwali 2025 Date and Schedule: দীপাবলি, অর্থাৎ আলোর উৎসব, ভারতের অন্যতম প্রধান এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এই উৎসব শুধু হিন্দুধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও পালন করে থাকেন। ২০২৫ সালে, দীপাবলির এই পঞ্চদিবসীয় উৎসব শুরু হবে ২০শে অক্টোবর, সোমবার, ধনতেরাসের মাধ্যমে এবং শেষ হবে ২৪শে অক্টোবর, শুক্রবার, ভাইফোঁটা বা ভাই দুজের মাধ্যমে। মূল দীপাবলি বা লক্ষ্মী পূজা অনুষ্ঠিত হবে ২১শে অক্টোবর, মঙ্গলবার। এই উৎসব মূলত অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয়কে চিহ্নিত করে। ধর্মীয় তাৎপর্যের পাশাপাশি, দীপাবলি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়ে পরিবার ও বন্ধুরা একত্রিত হয়, আনন্দ ভাগ করে নেয় এবং নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করে। এই উৎসবের প্রস্তুতি অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়, যার মধ্যে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, নতুন পোশাক কেনা এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি তৈরি করা অন্তর্ভুক্ত।

দীপাবলি ২০২৫: সম্পূর্ণ নির্ঘণ্ট ও সময়সূচী

প্রত্যেক বছর কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপাবলি উদযাপিত হয়। তবে এই উৎসব কেবল একদিনের নয়, এটি পাঁচ দিন ধরে চলে। নিচে ২০২৫ সালের দীপাবলি উৎসবের সম্পূর্ণ নির্ঘণ্ট একটি তালিকার মাধ্যমে দেওয়া হলো, যা Drik Panchang-এর মতো নির্ভরযোগ্য পঞ্জিকা অনুসারে তৈরি।

উৎসবের নাম তারিখ ও দিন তিথি ও সময় তাৎপর্য
ধনতেরাস (Dhanteras) ২০ অক্টোবর, সোমবার ত্রয়োদশী তিথি শুরু: ২০ অক্টোবর, দুপুর ০১:০৩ এ ত্রয়োদশী তিথি শেষ: ২১ অক্টোবর, দুপুর ০৩:০৮ এ ভগবান ধন্বন্তরির পূজা এবং সোনা, রূপা বা নতুন বাসনপত্র কেনার প্রথা।
নরক চতুর্দশী (Choti Diwali) ২১ অক্টোবর, মঙ্গলবার চতুর্দশী তিথি শুরু: ২১ অক্টোবর, দুপুর ০৩:০৮ এ চতুর্দশী তিথি শেষ: ২২ অক্টোবর, বিকাল ০৫:০৮ এ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নরকাসুর বধের বিজয় উদযাপন। বাংলায় এটি ভূত চতুর্দশী নামে পরিচিত।
দীপাবলি / লক্ষ্মী পূজা ২১ অক্টোবর, মঙ্গলবার অমাবস্যা তিথি শুরু: ২২ অক্টোবর, বিকাল ০৫:০৮ এ অমাবস্যা তিথি শেষ: ২৩ অক্টোবর, সন্ধ্যা ০৬:৫০ এ লক্ষ্মী পূজার মুহূর্ত: সন্ধ্যা ০৬:১৪ থেকে রাত ০৮:১৬ পর্যন্ত (প্রদোষ কাল) মা লক্ষ্মী ও গণেশের পূজা। প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করা হয়।
গোবর্ধন পূজা (Annakut) ২৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার প্রতিপদ তিথি শুরু: ২৩ অক্টোবর, সন্ধ্যা ০৬:৫০ এ প্রতিপদ তিথি শেষ: ২৪ অক্টোবর, সন্ধ্যা ০৮:০৮ এ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বত উত্তোলনের স্মৃতিচারণ।
ভাই ফোঁটা (Bhai Dooj) ২৪ অক্টোবর, শুক্রবার দ্বিতীয়া তিথি শুরু: ২৪ অক্টোবর, সন্ধ্যা ০৮:০৮ এ দ্বিতীয়া তিথি শেষ: ২৫ অক্টোবর, রাত ০৮:৫৩ এ ভাই ও বোনের মধ্যেকার পবিত্র সম্পর্ক উদযাপন।

দ্রষ্টব্য: তিথির সময়কাল বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে। উপরের সময়সূচীটি ভারতীয় সময় (IST) অনুসারে দেওয়া হয়েছে।

দীপাবলির তাৎপর্য: কেন এই উৎসব এত গুরুত্বপূর্ণ?

দীপাবলি নিছকই একটি আলোর উৎসব নয়, এর পিছনে রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক, পৌরাণিক এবং সামাজিক তাৎপর্য। “দীপাবলি” শব্দটি সংস্কৃত “দীপ” (প্রদীপ) এবং “আবলী” (সারি) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ “প্রদীপের সারি”। এই প্রদীপের আলো কেবল বাহ্যিক অন্ধকার দূর করে না, বরং মানুষের ভেতরের অন্ধকার, অজ্ঞতা এবং সকল প্রকার অশুভ শক্তিকেও দূর করে।

আধ্যাত্মিক এবং পৌরাণিক তাৎপর্য

দীপাবলির সঙ্গে একাধিক পৌরাণিক কাহিনী জড়িত, যা এই উৎসবকে আরও মহিমান্বিত করে তুলেছে।

  1. শ্রী রামের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন: দীপাবলির সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনীটি হলো ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রী রামের চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে রাবণকে বধ করে সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসা। রামায়ণের বর্ণনা অনুসারে, অযোধ্যার প্রজারা তাদের প্রিয় রাজাকে স্বাগত জানাতে গোটা রাজ্য প্রদীপের আলোয় সাজিয়ে তুলেছিল। সেই থেকেই এই দিনে প্রদীপ জ্বালিয়ে অশুভের বিনাশ এবং শুভের আগমনকে উদযাপন করা হয়।
  2. শ্রীকৃষ্ণের নরকাসুর বধ: দ্বাপর যুগে, নরকাসুর নামে এক অত্যাচারী অসুর ১৬,০০০ নারীকে অপহরণ করে নিজের কারাগারে বন্দী করে রেখেছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে সেই নারীদের উদ্ধার করেন। এই বিজয়কে স্মরণ করতে নরক চতুর্দশী বা ছোট দিওয়ালি পালন করা হয়, যা মন্দের উপর ভালোর জয়ের প্রতীক।
  3. লক্ষ্মীর আবির্ভাব: পুরাণ অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দেবী লক্ষ্মী প্রকট হয়েছিলেন। মা লক্ষ্মীকে ধন, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। তাই দীপাবলির রাতে ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়, যাতে তাঁর কৃপায় সারা বছর গৃহে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

দীপাবলি ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এক সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।

  • ঐক্য ও সম্প্রীতি: এই উৎসব পরিবার, বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের একত্রিত করে। মানুষ একে অপরের বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করে, মিষ্টি বিতরণ করে এবং একসঙ্গে আনন্দ করে, যা সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে।
  • নতুন সূচনা: দীপাবলিকে একটি নতুন সূচনার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। মানুষজন তাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, পুরনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দেয় এবং নতুন জিনিস কেনে। ব্যবসায়ীরা এই দিনে নতুন খাতা শুরু করেন, যাকে “চোপড়া पूजन” বলা হয়। এটি পুরনো ঋণ ও নেতিবাচকতা ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করার বার্তা দেয়।
  • শিল্প ও সংস্কৃতির উদযাপন: দীপাবলির সময় ঘর সাজানোর জন্য আলপনা বা রঙ্গোলি তৈরি করা হয়, যা ভারতের লোকশিল্পের এক সুন্দর নিদর্শন। বিভিন্ন ধরনের লোকনৃত্য ও সংগীতের মাধ্যমেও এই উৎসবকে বরণ করে নেওয়া হয়।

পঞ্চদিবসীয় দীপাবলি উৎসবের বিস্তারিত বিবরণ

দীপাবলির প্রতিটি দিনের নিজস্ব বিশেষত্ব ও রীতিনীতি রয়েছে। আসুন, এই পাঁচ দিনের উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

প্রথম দিন – ধনতেরাস (Dhanteras)

ধনতেরাস শব্দটির “ধন” অর্থ সম্পদ এবং “তেরাস” অর্থ ত্রয়োদশী তিথি। এই দিনটিকে ভগবান ধন্বন্তরির জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়, যিনি সমুদ্র মন্থনের সময় অমৃতের কলস নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ধন্বন্তরিকে আয়ুর্বেদের জনক এবং দেবতাদের বৈদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু লাভের জন্য এই দিনে তাঁর পূজা করা হয়।

এই দিনে সোনা, রূপা বা পিতলের মতো ধাতব জিনিসপত্র কেনা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, ধনতেরাসে কেনা জিনিস সারা বছর ধরে সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। সন্ধ্যায়, বাড়ির মূল দরজার বাইরে যমরাজের উদ্দেশ্যে একটি প্রদীপ জ্বালানো হয়, যা “যমদীপদান” নামে পরিচিত। এটি পরিবারের সদস্যদের অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য করা হয়।

দ্বিতীয় দিন – নরক চতুর্দশী বা ছোট দিওয়ালি (Naraka Chaturdashi)

এই দিনটি মূলত অশুভ শক্তির বিনাশের দিন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক নরকাসুর বধের বিজয়কে এই দিনে স্মরণ করা হয়। ভারতের অনেক অঞ্চলে এই দিনে খুব ভোরে উঠে তেল মেখে স্নান করার প্রথা রয়েছে, যা শরীর ও মনকে শুদ্ধ করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

বাংলায় এই দিনটি ভূত চতুর্দশী নামে পরিচিত। এই দিনে চোদ্দ শাক খাওয়ার এবং সন্ধ্যায় বাড়িতে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানোর রীতি প্রচলিত আছে। বিশ্বাস করা হয় যে, এই চোদ্দটি প্রদীপ পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা এবং অশুভ শক্তিকে বাড়ি থেকে দূরে রাখার জন্য জ্বালানো হয়।

তৃতীয় দিন – দীপাবলি বা লক্ষ্মী পূজা (Diwali / Lakshmi Puja)

এটিই দীপাবলি উৎসবের মূল দিন। এই সন্ধ্যায় দেবী লক্ষ্মী ও ভগবান গণেশের পূজা করা হয়। গণেশকে বিঘ্নহর্তা বা সকল বাধা দূরকারী দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়, আর দেবী লক্ষ্মী হলেন ধন ও সমৃদ্ধির প্রতীক। ঘরের প্রতিটি কোণায় প্রদীপ, মোমবাতি এবং আধুনিক বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়ে সাজানো হয়। এই আলো অন্ধকার ও অজ্ঞতাকে দূর করে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আগমনকে স্বাগত জানায়। মানুষ নতুন পোশাক পরে, বন্ধু ও আত্মীয়দের মধ্যে মিষ্টি ও উপহার বিনিময় করে এবং আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করে।

চতুর্থ দিন – গোবর্ধন পূজা ও অন্নকূট (Govardhan Puja and Annakut)

এই দিনটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জড়িত। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ব্রজবাসীরা বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাদের বোঝান যে, গোবর্ধন পর্বত তাদের গবাদি পশুদের খাদ্য জোগায় এবং তাদের জীবনধারণে সহায়তা করে, তাই ইন্দ্রের বদলে গোবর্ধন পর্বতের পূজা করা উচিত। এতে ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ আঙুলে পুরো গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরে সমস্ত ব্রজবাসীকে রক্ষা করেন।

সেই দিনটিকে স্মরণ করে গোবর্ধন পূজা করা হয়। এই দিনে “অন্নকূট” উৎসবও পালিত হয়, যেখানে বিভিন্ন ধরনের নিরামিষ পদ রান্না করে ভগবানকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।

পঞ্চম দিন – ভাই ফোঁটা বা ভাই দুজ (Bhai Phonta / Bhai Dooj)

দীপাবলি উৎসবের শেষ দিনটি ভাই ও বোনের পবিত্র সম্পর্ককে উৎসর্গ করা হয়। এই দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দন বা দইয়ের ফোঁটা দিয়ে তাদের দীর্ঘায়ু, স্বাস্থ্য এবং সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে। ভাইয়েরা বোনদের উপহার দেয় এবং তাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

এর পেছনের পৌরাণিক কাহিনীটি হলো, এই দিনে মৃত্যুর দেবতা যমরাজ তাঁর বোন যমুনার বাড়িতে গিয়েছিলেন। যমুনা তাঁর ভাইকে আরতি করে, ফোঁটা দিয়ে বরণ করে নেন। যমরাজ এতে অত্যন্ত খুশি হয়ে বর দেন যে, যে ভাই এই দিনে তার বোনের কাছ থেকে ফোঁটা নেবে, সে কখনও অকালে মৃত্যুবরণ করবে না। সেই থেকেই এই প্রথা চলে আসছে।

দীপাবলি এবং অর্থনীতি: উৎসবের আর্থিক প্রভাব

দীপাবলি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, এটি ভারতের অর্থনীতির একটি অন্যতম চালিকাশক্তি। এই সময়ে  ব্যয় (consumer spending) উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স (CAIT)-এর তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দীপাবলি মরসুমে ভারতে লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ২০২২ সালে এই ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ১.২৫ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। উৎসবের সময় মানুষ সোনা-রূপা, পোশাক, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, গৃহসজ্জার সামগ্রী এবং যানবাহন কিনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, দীপাবলির সময় ভারতের খুচরা বাজারে প্রায় ৩০-৪০% বিক্রি বেড়ে যায়।

এই উৎসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুমোরেরা লক্ষ লক্ষ মাটির প্রদীপ তৈরি করেন, মিষ্টির দোকানদাররা বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি প্রস্তুত করেন এবং হস্তশিল্পীরা ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। বর্তমানে, Amazon এবং Flipkart-এর মতো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলিও দীপাবলির সময় বিশেষ ছাড় এবং অফার দিয়ে বিপুল পরিমাণে ব্যবসা করে, যা ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।

আধুনিক দীপাবলি: ঐতিহ্য ও পরিবেশগত উদ্বেগ

সময়ের সাথে সাথে দীপাবলি পালনের পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ঐতিহ্যবাহী মাটির প্রদীপের পাশাপাশি আধুনিক বৈদ্যুতিক আলো এবং আতশবাজির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তবে এই আধুনিকতার সঙ্গে কিছু গুরুতর উদ্বেগও জড়িত, যার মধ্যে অন্যতম হলো পরিবেশ দূষণ।

শব্দ ও বায়ু দূষণ

দীপাবলির সময় অতিরিক্ত আতশবাজি পোড়ানোর ফলে ব্যাপক হারে বায়ু ও শব্দ দূষণ হয়। আতশবাজিতে ব্যবহৃত বারুদ এবং রাসায়নিক পদার্থ, যেমন – সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড এবং ভারী ধাতু বাতাসে মিশে যায়। এর ফলে বাতাসের গুণমান সূচক (Air Quality Index – AQI) বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

ভারতের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ (CPCB)-এর তথ্য অনুযায়ী, দীপাবলির পরের দিনগুলিতে দিল্লি, কলকাতা এবং মুম্বাইয়ের মতো বড় শহরগুলিতে AQI মাত্রা প্রায়শই “Severe” বা “Hazardous” স্তরে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, এই দূষিত বায়ু শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, হৃদরোগ এবং অন্যান্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। আতশবাজির তীব্র শব্দ শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং পশু-পাখিদের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সবুজ দীপাবলির পথে (Towards a Green Diwali)

পরিবেশগত এই উদ্বেগগুলির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে “সবুজ দীপাবলি” বা “পরিবেশ-বান্ধব দীপাবলি” পালনের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট শব্দ দূষণকারী এবং ক্ষতিকারক রাসায়নিকযুক্ত আতশবাজি বিক্রি ও ব্যবহারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

  • সবুজ বাজি (Green Crackers): কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (CSIR) এমন কিছু বাজি তৈরি করেছে যা প্রচলিত বাজির তুলনায় ৩০-৪০% কম দূষণ ছড়ায়। এগুলিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার কম থাকে।
  • জনসচেতনতা: বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে দীপাবলি উদযাপনের জন্য প্রচার চালাচ্ছে। আতশবাজির পরিবর্তে প্রদীপ জ্বালানো, রঙ্গোলি তৈরি করা এবং দুঃস্থদের সাহায্য করার মতো ইতিবাচক কাজে মানুষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
  • বিকল্প উদযাপন: অনেক সম্প্রদায় এখন আতশবাজির পরিবর্তে লেজার লাইট শো বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে, যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই উৎসবের আনন্দকে বজায় রাখে।

 আলোর উৎসবের শাশ্বত আবেদন

দীপাবলি একাধারে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মেলবন্ধন। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, এটি একটি দর্শন যা আমাদের শেখায় যে অন্ধকার যতই গভীর হোক না কেন, জ্ঞানের একটি ছোট প্রদীপই তা দূর করার জন্য যথেষ্ট। এটি আমাদের ভেতরের অশুভ শক্তিকে জয় করে সততা, করুণা এবং জ্ঞানের আলো জ্বালানোর অনুপ্রেরণা দেয়।

২০২৫ সালের দীপাবলি আমাদের জীবনে নতুন আশা, আনন্দ এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসুক। আসুন, আমরা এই উৎসবকে শুধুমাত্র বাহ্যিক আড়ম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর আসল তাৎপর্যকে উপলব্ধি করি। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এই আলোর উৎসব পালন করি এবং সকলের জীবনে ইতিবাচকতার আলো ছড়িয়ে দিই।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।